যে মৃত্যুর কথা কখনও ভুলবেন না শেখ মোহাম্মদ
দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা ‘কিস্সাতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে দশম পর্ব।
শৈশবের যে স্মৃতিটি আমি কখনো ভুলবো না, তা হলো আমার দেখা সেরা মানুষদের একজনের মৃত্যুর স্মৃতি। তিনি হলেন আমার দাদা শেখ সাঈদ বিন মাকতুম। ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
শেখ সাঈদ বিন মাকতুমকে বাদ দিয়ে কেউ দুবাইয়ের কথা কল্পনা করতে পারে না। তিনি টানা ৪৬ বছর আমিরাত শাসন করেন। আধুনিক দুবাইয়ের যাত্রা শুরু তারই হাত ধরে। সে যাত্রা এখনও চলছে।
আমার এখনও সেই দিনটির কথা স্পষ্ট মনে আছে। ফজরের নামাজের পরই তার আত্মা তার রবের কাছে চলে যায়। আমার দাদার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে আমার বাবার সান্নিধ্যে। দাদার শোকে আমার বাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন মায়ের খুব কাছাকাছি থাকতাম। দাদার মৃত্যুর পর নারীদের চিৎকার করে কাঁদতে দেওয়া হয়নি, কারণ তা আল্লাহর তকদিরের ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপত্তির মতো শোনা যায়।
আমার দাদার মরদেহ যখন বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আমার বাবা ভিড়ের মাঝে খাটিয়ার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আমার হাতটা শক্তভাবে ধরেছিলেন। আমি জানি না কেন সেদিন তিনি আমাকে এতটা শক্ত করে ধরেছিলেন।
দাদার মরদেহ তার বড় মেয়ে শেখ মোজা বিনতে সাঈদের বাড়িতে নেওয়া হয়। তিনি দাদাকে খুবই ভালোবাসতেন এবং দাদার মৃত্যুর আগে তার অসুস্থতার সময় তার শয্যাপাশে ছিলেন। তাকে এক নজর দেখানোর জন্য মরদেহটি তার বাড়িতে নেওয়া হয়।
এরপর আমরা সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কবরস্থানে পৌঁছে যাই। আমার বাবা এবং আমার চাচারা খুব যত্ন সহকারে আমার দাদার খাটিয়াটি নামাতে শুরু করেন। আমি আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষটিকে কবরের পাশে রাখার দৃশ্য দেখলাম। এরপরে আমরা তার জানাজার নামাজ পড়ি।
শেখ সাঈদের মৃত্যুর সংবাদটি দুবাইয়ের লোকদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তারা তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতো। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক, উদার ও দয়ালু মানুষ। তিনি সবসময়ই সত্যের সাথে থাকতেন।
খুব প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করতেন। নিজের শাসনামলে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলেও দাদা দুবাইকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করেন।
শেখ সাঈদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন ১৯২১ সালে। তার সময়টাতে আমিরাতে মুক্তার বাণিজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ব্যবসায়ীদের দুবাই যে বাণিজ্যিক ও শুল্ক সুবিধা দিয়েছিল, তা তার আমলেই জোরদার হয়। বাণিজ্যিক ও অন্যান্য আরও অনেক খাতে আজ দুবাইয়ের যে চিত্র আমরা দেখি তার বীজ বপণ করেছিলেন আমার দাদা শেখ সাঈদই।
নবম পর্ব : প্রকৃতির তাণ্ডব থেকেও নেতৃত্বের শিক্ষা নিয়েছেন দুবাই শাসক
শেখ সাঈদের রাজত্বকালে দুবাই অনেক সংকটেও পড়েছিল। তবে প্রতিবারই তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তা সামাল দেন। বিশেষ করে ১৯৩০ সালে বিশ্ব যখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছিল, মুক্তা ব্যবসায় অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে শেখ সাঈদও তখন এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
এছাড়াও আরও কিছু দুর্ঘটনা তার জন্য রীতিমতো পরীক্ষা হয়ে সামনে এসেছিল।
মুক্তার বাণিজ্যের ওপর ভর করে দাঁড়ানো আমিরাতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির একাধিক বিকল্পও খুঁজে পান শেখ সাঈদ। চল্লিশের দশকেই আমিরাত আয়ের উৎসে বৈচিত্র আনে, পরিষেবাগুলোকে উন্নত করে এবং বন্দর ও স্থল পরিবহন উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে।
দুবাইয়ের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অবদান ছিল আমার বাবা শেখ রাশেদেরও। তরুণ এই রাজকুমার ছিলেন শেখ সাঈদের ডান হাত। তিনি দুবাই গঠনে বিভিন্ন পর্যায়ে তার সাথে ছিলেন।
১৯৪৪ সালে দুবাই এবং উপকূলীয় বেশিরভাগ অঞ্চলে মহামারি দেখা দেয়। এতে বহু মানুষ মারা যান। এ সময় শেখ সাঈদ তার সম্পদের বড় একটা অংশ টিকা সরবরাহের জন্য ব্যয় করেন। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে মানুষের চিকিৎসায় একটি হাসপাতালের উদ্বোধন করেন তিনি। হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ তিনি নিজের অর্থ থেকে প্রদান করেন।
হাসপাতালটিতে সবচেয়ে উন্নত মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। ১৯৫০ এর দশকে এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্র হয়ে ওঠে ওই হাসপাতালটি।
শিক্ষার বিকাশেও বড় অবদান রাখেন শেখ সাঈদ। কথিত আছে, শেখ সাঈদের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল, খুব ভোরে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের দিকে যেতে দেখা। তিনি প্রতিদিন গাড়িতে করে শিক্ষার্থীদের অনুসরণ করতেন।
আমার দাদা আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। আমার ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় তার সাথেই কেটেছে। দাদার মৃত্যুর পর দলে দলে মানুষ আমাদের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে ছুটে আসেন।
এনএফ