যেভাবে সহিংসতার স্ফুলিঙ্গ ছড়াল ইসরায়েল
আব্দ আল-ফাত্তাহ ইসকাফির বয়স ৭১ বছর। প্রাচীন নগরী জেরুজালেমের ঐতিহাসিক দামেস্ক গেটের কাছের সারি সারি গাছের এক সড়কের পাশের বাড়িতে নিজের ৬ বছর বয়স থেকে বসবাস করে আসছেন। নিজের বাড়িতে থাকার অধিকার আছে কি না তা নিয়ে কট্টরপন্থী ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সাথে আদালতে গত কয়েক দশক ধরে লড়ছেন তিনি।
শেখ জারাহ বসতির অন্যান্য পরিবারগুলোও বাড়ি হারানোর মুখোমুখি হয়েছেন। দীর্ঘদিনের আইনি লড়াইয়ের কারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তারা ধ্বংস হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে চলতি মাসে শেখ জারাহ বসতির বাসিন্দাদের ঝুলে থাকা মামলার চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা ছিল।
অনেক ফিলিস্তিনির জন্য এই আইনি লড়াই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠে। যে লড়াইকে তারা পূর্ব জেরুজালেমে নিজেদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক ইসরায়েলি অবৈধ উচ্ছেদ ঠেকানোর এক অস্ত্র হিসেবে দেখে। শুরু হয় সম্ভাব্য উচ্ছেদের ক্ষোভ থেকে বিস্তৃত পরিসরের উত্তেজনা; যা গত সপ্তাহে ইসরায়েলের ভেতরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধে গড়ায়।
ভিন্ন ধর্মের দু’টি ক্যালেন্ডার এবং আদালতের আমলাতন্ত্রের চেয়ারের ধীরগতির নড়াচড়া গত ১০ মে-কে প্রাণঘাতী সংঘাতের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
ওইদিন ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে শেখ জারাহ বসতি মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ওই সোমবার ছিল হিব্রু আইয়ার মাসের ২৮তম দিন; এই দিনে ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদীরা প্রাচীন নগরী জেরুজালেমে বিতর্কিত ‘জেরুজালেম দিবস’র পদযাত্রা আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলেন।
১৯৬৭ সালে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে জেরুজালেম দখলে নেয় ইসরায়েল। সেই দখলদারিত্বের বার্ষিকীর দিনে ‘জেরুজালেম দিবস’ উদযাপন করেন ইসরায়েলিরা। এদিকে, মুসলিমদের অন্যতম পবিত্র রমজান মাস প্রায় শেষের দিকে। এই মাসে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গনে নামাজ আদায়ের জন্য প্রত্যেকদিন প্রচুরসংখ্যক মুসলিম জমায়েত হন। ইহুদিদের কাছে মুসলিমদের পবিত্র এই স্থাপনা টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত।
দামেস্ক গেটের কাছে মসজিদ চত্বরে মুসল্লিদের ঐতিহ্যবাহী সমাগম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, উচ্ছেদের শঙ্কা এবং ক্ষোভ ও অন্যান্য ঘটনা যেমন— কট্টর ডানপন্থী ইহুদি গোষ্ঠী লেহাভার দাঙ্গা, পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের গত কয়েক সপ্তাহের সংঘর্ষ চরমে পৌঁছায় ১০ মে।
চ্যানেল ১৩ টেলিভিশনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাভিভ ড্রাকার বলেন, বর্তমান উত্তেজনা বৃদ্ধির সম্ভবত এক নম্বর কারণ আল-আকসা মসজিদে সহিংসতা। এমনকি ইসরায়েল এই স্থাপনার সংবেদনশীলতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও কিছু কারণে আমরা একই ভুল বার বার করছি। যখন রমজান মাস, ঈদুল ফিতর এবং জেরুজালেম দিবস নিয়ে চারদিকে উত্তেজনা চলছে, তখন ইসরায়েলি বাহিনীর গ্রেনেড নিয়ে মসজিদের ভেতরে ঢুকে পড়া সেই উত্তেজনায় আগুন জ্বালিয়ে দেবে; এটাই স্বাভাবিক।
ইহুদিবাদী ইসরায়েলিদের মধ্যেও উত্তেজনা ছিল। গত এপ্রিলের মাঝের দিকে চলন্ত একটি ট্রেনে ইহুদি এক ব্যক্তিকে আঘাত করে এক কিশোর। এই দৃশ্য সে টিকটিক ভিডিও হিসেবে প্রকাশ করলে ইহুদিদের ওপর হুবহু একই ধাঁচের আক্রমণ শুরু হয় এবং এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসরায়েলের অ্যাটর্নি জেনারেল শেষ মুহূর্তে শেখ জারাহ মামলার বিষয়ে আরও তদন্ত ও সময়ের দরকার বলে আদালতকে জানানোর পর শুনানি পিছিয়ে যায়। এই মামলাটিকে সরকার ব্যক্তিগত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে রিয়েল এস্টেট বিরোধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের আবেদনের পর মুসলিম এলাকা থেকে জেরুজালেম দিবসের পদযাত্রা অন্য এলাকায় করার নির্দেশ দেয় পুলিশ। কিন্তু ততক্ষণে সহিংসতার স্ফুলিঙ্গ তার নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে নেয়।
সোমবার সকালের দিকে হারাম আল-শরিফ ভবনে অভিযান চালায় ইসরায়েলি পুলিশ। কয়েকদিনের সহিংস পরিস্থিতির মাঝে মসজিদ চত্বরে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। টিয়ার গ্যাস, স্টান গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। সেদিন সন্ধ্যায় গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল হামাস ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায়। শেখ জারাহ এবং হারাম আল-শরিফ থেকে নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারে ইসরায়েলকে দেওয়া আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পরই ইসরায়েলে রকেট ছোড়ে হামাস।
শেখ জারাহ মামলাটি অনেক ফিলিস্তিনির জন্য আত্মরক্ষার, আত্মমর্যাদার লড়াই। কারণ ইসরায়েলি আইনের কারণে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ১৯৪৮ সালে হারানো সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেন। কিন্তু একই সময়ে ইসরায়েলের অংশে পরিণত হওয়া সম্পত্তির মালিকানা দাবি করার একই ধরনের কোনও আইন ফিলিস্তিনিদের জন্য নেই। ফিলিস্তিনি রাজনীতি বিশ্লেষক ইউসুফ মুনায়ের বলেন, আইনটি লেখাই হয়েছে অ-ইহুদিদের ওপর ইহুদিদের সুবিধা দেওয়ার জন্য।
এই বিবাদের কেন্দ্রে যে পরিবারগুলো আছে; তারা শেখ জারাহতে ১৯৫০ এর দশক থেকে বসবাস করছেন। ১৯৪৮ সালে যে যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়; সেই যুদ্ধে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। পরে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় তারা আবারও শেখ জারাহতে বসবাস শুরু করেন।
শেখ জারাহতে ৫৬ বছর ধরে বসবাস করে আসা ৭১ বছর বয়সী মুহাম্মদ আল-সাব্বাগ বলেন, ‘ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ইসরায়েলের সরকার সমর্থিত চোর। আমরা আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে যাবো না।’
ইসরায়েলের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, সেখানে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরে পদ্ধতিগত বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ বেশিরভাগ শহরে দারিদ্র ও বেকারত্বের উচ্চ হার রয়েছে এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ২০১৮ সালে নেসেটে একটি ইহুদি জাতি-রাষ্ট্র আইন পাস হয়। এই আইনে শুধুমাত্র ইহুদিদেরই ইসরায়েলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এমনকি হিব্রুর পাশাপাশি দেশটিতে সরকারি ভাষা হিসেবে আরবির যে স্বীকৃতি ছিল সেটি বাতিল করা হয়।
ইসরায়েল-আরব যৌথ সংখ্যালঘু দলগুলোর প্রধান আয়মান ওদেহ সেই সময় বলেছিলেন, ‘ইহুদি আধিপত্য দিয়ে নেসেট একটি আইন পাস করেছে। এই আইনে আমাদের সবসময় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বলা হয়েছে।’ একই বছরে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট করেন। এতে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল সব নাগরিকের দেশ নয়... ইসরায়েল ইহুদি জনগণের রাষ্ট্র এবং শুধুমাত্র তাদেরই।’
ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ লাখ বা ২০ শতাংশই ফিলিস্তিনি— যারা মূলত মুসলিম। যাদের কিছুসংখ্যক খ্রিস্টান এবং দ্রুজ (আরবি ভাষাভাষি সংখ্যালঘু; যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন)। তাদের প্রায় সবাই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পর সেখানে থেকে যাওয়া লোকজনের বংশধর। এই জনগণের বেশিরভাগকে সেই সময় নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তাদের পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং জর্ডান, লেবানন ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের শরণার্থী সম্প্রদায়ের মাঝে। বর্তমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষত মুছতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
ইসরায়েলের ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউটের রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ফেলো অধ্যাপক জিডিওন রাহাত বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইসরায়েলি সমাজের বেশিরভাগ মানুষকে হতাশ করেছে। তবে সাম্প্রদায়িক আস্থা পুনর্স্থাপনে গভীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মসূচির দরকার হবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
এমনকি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিণতি ছাড়াই চলমান সংঘাত ইসরায়েলি রাজনীতির চিত্র রাতারাতি বদলে দিয়েছে। ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দুই বছরের মধ্য চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়ে জোট সরকার গঠন করতে গিয়ে তার পদ হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন। পরে ইয়ার লাপিদ মধ্যস্থতা করে বিরোধী মধ্যপন্থী আরব ইসরায়েলি একটি দলকে ইসরায়েলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারে নিয়ে আসেন। ইসলামপন্থী দল রাম নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর জোট সরকার গঠনের আলোচনা ভেস্তে যায়।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ইসরায়েলের বিরোধী নেতা বেনি গ্যান্তেজকে আংশিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তিনি দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তবে ক্ষমতায় যেতে নেতানিয়াহুর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং যেকোনো জোট সরকার গঠনের অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে হাজির হয়েছেন তিনি।
চ্যানেল ১৩’র বিশ্লেষক ড্রাকার বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষায় ছিলেন নেতানিয়াহু। নতুন জোট সরকার গঠন এবং এই প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত তার জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। কারণ বর্তমান যে সরকার রয়েছে তা প্রায় ভেঙে পড়ার দশা হয়েছিল। কিন্তু আগামী কয়েক মাস দেশটির ক্ষমতায় থাকবেন নেতানিয়াহু; সম্ভবত আরও কয়েক বছর।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।
এসএস