পশ্চিমবঙ্গে এবার কিশোরী হত্যায় পুলিশের বিরুদ্ধে জনরোষ
বাঁশদ্রোণীর পর ফের জয়নগর এবং আবারো জনতার ক্ষোভের মুখে পুলিশ। জয়নগরে কিশোরীর মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দিয়েছে জনতা।
আর জি কর মামলায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে। খোদ ওসিকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। এরপর একাধিক ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে জনতার রোষ ফেটে পড়েছে। বাঁশদ্রোনীর পর এবার জয়নগরে মানুষের ক্ষোভের মুখে পুলিশ।
পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা
শনিবার সকালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর থানা এলাকায় উদ্ধার হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর মরদেহ। এরপর থেকে গোটা এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
মহিষমারি এলাকার ছাত্রী শুক্রবার বিকেলে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে গিয়েছিল। রাত হলেও সে বাড়ি না ফেরায় শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। না পেয়ে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে যান পরিজনেরা। নিখোঁজ ডায়েরি লেখাতে চান তারা। অভিযোগ, পুলিশ সেই অভিযোগ নিতে চায়নি, বরং পরামর্শ দেওয়া হয়, ডায়েরি করতে যেতে হবে জয়নগরে৷
শনিবার সকালে ছাত্রীর বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে পুকুর থেকে উদ্ধার হয় তার দেহ৷।পরিবারের দাবি, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে তাকে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এরপরই পুলিশের উপর গিয়ে পড়ে জনরোষ। স্থানীয় ফাঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামবাসী। তছনছ করে দেয়া হয় ফাঁড়ি। আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দেয় জনতা। রাস্তার উপর টায়ার জ্বালিয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। পুলিশ বাহিনী সেখানে এলে জনতা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধস্তাধস্তি, মারধরের মুখে পড়ে পুলিশ পিছু হটে। পুলিশকে লক্ষ্য করে নারীদের ঝাঁটা দিয়ে মারতে দেখা যায়।
রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় মহিষমারি। পুলিশ পাল্টা লাঠিচার্জ করে৷ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চায়। দিনভর দফায় দফায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় এলাকায়।
পুলিশের বিরুদ্ধে রোষ
থানার আইসি, মহকুমা পুলিশ আধিকারিক ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাদের ঘেরাও করে উত্তেজিত গ্রামবাসী।পরে ঘটনাস্থলে আসেন বারুইপুর পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার পলাশ চন্দ্র ঢালী। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তিনি স্বীকার করেননি; বলেন, ‘‘গতকাল রাত নটার সময় আমরা খবর পাই। অভিযোগ পেয়েছি রাত ১২টা নাগাদ৷ সাড়ে ১২টায় মামলা রুজু করেছি। কোনো গাফিলতি হয়নি।''
কিশোরীর পরিবার ও গ্রামবাসীর দাবি, শুক্রবার পুলিশ তল্লাশি শুরু করলে ছাত্রীকে বাঁচানো যেত। পুলিশের গাফিলতিতেই প্রাণ গেল ১০ বছরের মেয়েটির। পুলিশ এদিন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ওই যুবকের নাম মোস্তাকিন সর্দার। ফুটেজে অভিযুক্তের সাইকেলে শেষবার দেখা গিয়েছে কিশোরীকে। পুলিশের দাবি, আটক যুবক দোষ স্বীকার করেছে।
এই ঘটনায় তৃণমূলকে আক্রমণ করে বিজেপি রাজ্যে সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সমাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘মহিলাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ বাংলার অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার প্রশ্ন, দেবীপক্ষের সূচনাতেও নিস্তার নেই বাংলার মেয়েদের! আপনার অপশাসনে আর কতগুলি বাংলার মেয়ের এই পরিণতি হবে!! ছিঃ৷''
কুণাল ঘোষ জবাবে লিখেছেন, ‘‘জয়নগরের বালিকার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা নিন্দনীয়৷ যে বা যারা দায়ী, চরম শাস্তি চাই৷ কিন্তু এই সুযোগে ধর্ষণ, খুনের রেকর্ড গড়া সিপিএম, বিজেপিসহ কিছু বিরোধীকে এখন সাধু সেজে অরাজকতা তৈরি করতে দেবেন না। পুজোর মরশুমে বিরাট চক্রান্ত চলছে অশান্তির।''
ক্ষোভের মুখে তৃণমূল
তৃণমূল নেতারা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। কুলতলির বিধায়ক গণেশ মণ্ডলকে তাড়া করে জনতা। এলাকায় পৌঁছান জয়নগরের সাংসদ তৃণমূলের প্রতিমা মণ্ডল। তার সঙ্গে বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের বচসা বাধে।
একসময়ে বাম রাজনীতির গড় কুলতলিতে এখন তৃণমূলের একচ্ছত্র দাপট। সেখানে তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে গো ব্যাক স্লোগান ওঠে। রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী ও সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এবং বাম যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় এলাকায় গেলে আর এক প্রস্থ উত্তেজনা তৈরি হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের এমনি রোষ বারবার দেখা যাচ্ছে৷ চলতি সপ্তাহে একইভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল কলকাতার দক্ষিণ শহরতলি এলাকার বাঁশদ্রোণী। জেসিবির নীচে পড়ে প্রাণ যায় এক স্কুল ছাত্রের৷ এরপর পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা৷ ভাঙচুর করা হয় জেসিবি।
রাস্তার হাল খুব খারাপ হওয়ায় এই দুর্ঘটনা। প্রতিবাদে পাটুলি থানার ওসিকে কাদাজলে নামিয়ে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হয় তাকে৷ পুলিশ বাহিনী পরে ওসিকে উদ্ধার করে।
সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছে। শাসকদলের অনুমতি ছাড়া তারা ব্যবস্থা নেয় না৷ আসামি কে হবে, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে তারা এগোয় না। সেই কারণেই তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠছে৷ পুলিশ যদি দল না দেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে তাহলে রোষের মুখে পড়তে হবে না।''
আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার পর নারী সুরক্ষা বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে নারীর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ফের প্রশ্ন তুলে দিয়েছে আরো একটি ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ।
একে সামাজিক ব্যাধির তকমা দেন অনেকে। কিন্তু বারবার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে কেন? রাজ্য শিশু সুরক্ষা আয়োগের সদস্য তুলিকা দাস ডিডাব্লিউকে বলেন, আমরা নিয়মিত পুলিশের সঙ্গে কাজ করি৷ তাদের তৎপর থাকতে বলি৷ কিন্তু কোন ঘটনা যে ঘটবে সেটা আগে তো জানা যায় না। তবু আরো কোন কোন উপায়ে সুরক্ষা বাড়ানো যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এনিয়ে আলোচনা করে আমরা সুপারিশ দেব।''
জুনিয়র চিকিৎসকদের লড়াই
এদিকে আর জি করের ঘটনার বিচার চেয়ে জুনিয়র চিকিৎসকেরা আন্দোলন করছেন দুই মাস হতে চলল। তাদের অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসন ও পুলিশ।
চিকিৎসকদের আন্দোলনের চাপে সরতে হয়েছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। লালবাজার অভিযান করে জুনিয়র চিকিৎসকেরা শিরদাঁড়ার প্রতিরূপ দিয়ে এসেছিলেন গোয়েলকে।
চিকিৎসকদের এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ছে বলে অন্যান্য ঘটনায় প্রতিবাদ জোরালো হচ্ছে, এমনটা মনে করেন অনেকে। মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘মানুষ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ করছে। থানায় গিয়ে পুলিশের ধমকে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে না। নারীরা নেমে আসছেন বিক্ষোভে৷ বাম আমলের শেষ চার বছর এই ছবি দেখা গিয়েছিল। অন্যায় দেখলে এভাবেই প্রতিবাদ, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।''
জুনিয়র চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি তুলে নিলেও সরকারের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছেন। শনিবার রাত সাড়ে আটটার মধ্যে সরকারের তরফ থেকে সদর্থক সাড়া না পেলে, ধর্মতলায় চিকিৎসকেরা অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর সঙ্গে শুরু হবে আমরণ অনশন।
শুক্রবার কলকাতা প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় অবস্থানে বসেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা। পুলিশের বিরুদ্ধে মঞ্চ প্রস্তুতকারক ডেকোরেটরদের বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে। চিকিৎসকেরা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ত্রিপল লাগিয়ে নিজেদের মঞ্চ বানিয়ে নেন।
শনিবার কলকাতা পুলিশ অবস্থানরত চিকিৎসকদের ই-মেইলে অনুরোধ করেছে, তারা যেন পুজোর সময় এই ব্যস্ত এলাকা থেকে অবস্থান তুলে নেন৷ না হলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হবে। যদিও এই ই-মেইলকে আমল দিচ্ছেন না আন্দোলনকারীরা৷ রাজ্য কী অবস্থান নেয়, সেদিকে তাকিয়ে তারা।
এসএমডব্লিউ