যে কারণে উজাড় হচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস
আকাশ ছেয়ে যায় ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে। দাউ দাউ করে জ্বলে আগুন। আগুনের উৎসস্থল থেকে ধোঁয়া আশপাশের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর এমন হাজার হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে ব্রাজিলের আমাজন ‘রেইন ফরেস্টে’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাজনে এমন অগ্নিকাণ্ডের কারণ হচ্ছে চাষের জমি এবং পশু চারণের মাঠ সৃষ্টি করা।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট বা ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল হচ্ছে আমাজন। আমাজন হলো জীববৈচিত্র্যের আধার। প্রায় ত্রিশ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং ১০ লাখ আদিবাসীর আবাসস্থল এই বন। পৃথিবীতে কার্বনের সবচেয়ে বড় ধারক এ বনের গাছগুলো। কয়েকটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত আমাজন। আমাজনের সবচেয়ে বেশি অংশ পড়েছে ব্রাজিলে।
আমাজন কার্বন শোষণ করে বলেই পৃথিবীতে তাপমাত্রা ধীরে বাড়ে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন তেমন ঘটে না। কিন্তু ভয়ের ব্যাপারটি হচ্ছে গত ১২ বছরের মধ্যে এবারই বন ধ্বংসের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্রাজিলের স্পেস এজেন্সি (আইএনপিই) এ তথ্য দিয়েছে।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১ হাজার ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আমাজন ধ্বংস হয়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায় তা ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে বনভূমি ধ্বংসের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫৩৬ বর্গ কিমি।
আমাজনকে বলা হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’। তাই ‘ফুসফুস’ ধ্বংসের পেছনে বিজ্ঞানীরা গত দুবছর ধরে যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটি হচ্ছে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারোর ক্ষমতা গ্রহণ। তারা বলছেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর উল্লেখযোগ্য হারে আমাজন ধ্বংস হওয়া শুরু হয়েছে। তিনি চাষাবাদ এবং খনন কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করছেন।
পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন আমাজন থেকেই আসে। কিন্তু ২০১৯ সালের হিসাবে দেখা গেছে, সে বছর আমাজনে ৭২ হাজার ৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের তুলনায় যা প্রায় ৮৩ শতাংশ বেশি।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, অনেক সময় বাতাস শুকনো থাকলে আগুন ধরে যেতে পারে। কিন্তু এতগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে না। অনেকাংশে এই অগ্নিকাণ্ডগুলো মানবসৃষ্ট। দেশটির সরকারি অবস্থানও এমন দাবির ভিত্তি জোরালো করে।
২০২০ সালের মধ্যে ব্রাজিলের লক্ষ্য ছিল বনভূমি ধ্বংসের পরিমাণ ৩ হাজার ৯০০ বর্গকিলোমিটারে নামিয়ে আনা। কিন্তু এর বিপরীতে নতুন প্রেসিডেন্ট এসেই কথিত উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করলেন। ব্রাজিলে বন ধ্বংস ও পরিবেশ আইন ভাঙার জন্য কৃষক এবং কাঠ ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে ফেডারেল এজেন্সিগুলো। ক্ষমতায় আসার পর নতুন প্রেসিডেন্ট ফেডারেল এজেন্সির জন্য অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছেন।
এর আগে আইএনপিই’র সঙ্গেও প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো বিরোধে জড়িয়েছেন। তার অভিযোগ ছিল, স্পেস এজেন্সিটি ভুল তথ্য দিয়ে ব্রাজিলের সুনাম নষ্ট করছে। এক বিবৃতিতে ক্লাইমেট অবজারভেটরি নামে ব্রাজিলের এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বলছে, আমাজনে অপরাধ তদন্ত সংস্থার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার সফল উদ্যোগের ফলাফল উঠে এসেছে আইএনপিই’র তথ্য-উপাত্তে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বিবিসির সায়েন্স এডিটর ডেভিড শাকম্যান বলেন, ‘আমাজন ধ্বংসের পরিমাণ বুঝতে পারা কঠিন। গত বছর আমি নিজে বন ধ্বংসের ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করেছি। বড় বড় গাছ কেটে পরে সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হতো। পশু চরানো এবং সয়াবিন চাষাবাদের জন্য বন সাফ করা হচ্ছিল। সে সময় বলা হতো, প্রতি মিনিটে একেকটি ফুটবল মাঠের মতো বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ বছর বন ধ্বংসের ব্যাপারটি আগের চেয়ে বেড়েছে। গত এক দশকের মধ্যে বনে সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডটি এ বছরই দেখা গেছে।’
মূল্যবান খনিজের জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট আমাজনকে বর্ণনা করেছেন ‘একটি পর্যায়ক্রমিক সারণী’ হিসেবে। এছাড়াও তিনি আমাজনে চাষাবাদ ও মূল্যবান ধাতু উত্তোলনে খননকাজে উৎসাহ দিচ্ছেন। এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় অন্যদের ওপর ক্ষিপ্তও হচ্ছেন তিনি। কিন্তু জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বারবার বলেছেন, আমাজনের কোটি কোটি গাছ কার্বনের বড় ধারক। এসব গাছ না থাকলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়বে।
আরএইচ/এএস