ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ড কি আঞ্চলিক যুদ্ধ উসকে দিতে পারে?
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া ‘হত্যাকাণ্ড’ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। গত বছরের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের ‘হিট লিস্টে’ ছিলেন হানিয়াহ। বুধবার ভোরের দিকে ইরানের রাজধানী তেহরানে তার বাসভবনে ইসরায়েলি হামলায় হামাসের সর্বোচ্চ এই নেতা নিহত হয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা তেহরানে হামাসের শীর্ষ নেতাকে হত্যার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ‘‘অপরাধী এবং সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে অবশ্যই কঠোর শাস্তি পেতে হবে। ইরান এটাকে হামাস নেতার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার কর্তব্য বলে মনে করে।’’
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, হানিয়াহকে ‘‘কাপুরুষোচিত’’ হত্যার ঘটনায় অনুশোচনা করতে হবে ইসরায়েলকে। তিনি বলেন, ইনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, মর্যাদা, সম্মান এবং গৌরব রক্ষা করা হবে। সন্ত্রাসী দখলদারদের কাপুরুষোচিত কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে।
৯ মাসের বেশি সময় ধরে চলা গাজায় যুদ্ধ অবসানের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য এখন খাদের কিনারে রয়েছে। এর মাঝেই হামাসের শীর্ষ নেতাকে হত্যার এই ঘটনা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আঞ্চলিক যুদ্ধ উসকে দিতে পারে কি-না সেই প্রশ্ন উঠছে।
• কে এই ইসমাইল হানিয়া?
কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর প্রধান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিসর এবং কাতারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সাথে গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাসের প্রধান নেতা ছিলেন তিনি। যুদ্ধবিরতির আলোচনা স্পষ্টতই এখন আটকে যাবে।
ইসরায়েল এখন পর্যন্ত তার মৃত্যুর ঘটনায় দায় স্বীকার করেনি এবং করার সম্ভাবনাও নেই। এর কারণ ইসরায়েল সাধারণত বিদেশে পরিচালিত গোপন অভিযানের বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করে না। ইসমাইল হানিয়াহ দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের প্রধান টার্গেট ছিলেন।
তেহরানের মতো এলাকায় হামাসের এই নেতাকে হত্যার ঘটনায় ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। ঠিক কীভাবে হামলা চালানো হয়েছিল সেই বিষয়ে এখনও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এতটুকু জানা যাচ্ছে, বাসভবনে বিস্ফোরণে এক দেহরক্ষীসহ প্রাণ হারিয়েছেন ইসমাইল হানিয়াহ। বিস্ফোরণটি দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বোমা নাকি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল, সেটি জানা যায়নি।
ইরানের অভিজাত সামরিক বাহিনী ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করছে।
• বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ উসকে দেবে এই হত্যাকাণ্ড?
ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ড পরবর্তী আগামী কয়েক ঘণ্টা কিংবা কয়েক দিনে অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যালোচনা করা হবে। প্রথমটি হল, হানিয়াহকে হত্যায় ইসরায়েল দায়ী বলে ধরে নেওয়া। যদিও ইরান প্রতিশোধ নেবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ হানিয়াহ গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার সময় ইরানি নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় ছিলেন। তার মৃত্যু ইরানজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করতে পারে। এর ফলে হামাসের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ নেওয়া হতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত এপ্রিলে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে ৩০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করেছিল ইরান। কনস্যুলেটে হামলায় আইআরজিসির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন।
হানিয়ার ওপর হামলার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য মাত্রার গোয়েন্দা তথ্য প্রাপ্তি এবং অভিযানের অবাধ সুযোগের ইঙ্গিত দেয়। এই মুহূর্তে ইরানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রম ব্যাপক মাত্রায় চালু রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা ইরানি বিজ্ঞানীদেরও হত্যা করেছে ইসরায়েল। এর মধ্যে রয়েছেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যা; যাকে ২০২০ সালে অত্যাধুনিক রিমোট-কন্ট্রোল মেশিনগান দিয়ে হত্যা করে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি ‘হিট লিস্টে’ যে হামাস নেতারা রয়েছেন, যতদূর বোঝা যায় তারা এখনও বেঁচে আছেন। গাজার রাজনৈতিক নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার দৃশ্যত এখনও সেখানে হামাসের অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চলতি মাসেই ইসরায়েল হামলা চালিয়ে হামাসের পলাতক নেতা মোহাম্মদ দেইফকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে দেইফের মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করেনি হামাস। এর আগেও কয়েকটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন হামাসের এই নেতা।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, লেবানন-ভিত্তিক সশস্ত্র ইসলামি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইরানের নির্দেশে ইসরায়েলে হামলা চালাবে কি না? হানিয়াহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণে ইসরায়েলি বিমান হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটেছে। বৈরুতে হামলায় হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করেছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
এখন ইরান যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, তা হতে পারে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহর মাধ্যমে। হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টি ইসরায়েলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনেও ইরানের অন্যান্য মিত্রগোষ্ঠী রয়েছে; যাদেরকে ইসরায়েলি স্বার্থে হামলা চালানোর জন্য আহ্বান জানাতে পারে তেহরান। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা গত সপ্তাহে তেল আবিবে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। যদিও ইসরায়েল হুথিদের হামলার দ্রুত পাল্টা জবাব দিয়েছে।
হানিয়া হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কী ঘটবে তা বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, হানিয়া হত্যাকাণ্ড গাজা যুদ্ধ এবং সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র: টাইমস, এশিয়া টাইমস, রয়টার্স।
এসএস