সাত বছর বয়সে শিকারে হাতেখড়ি দুবাই শাসকের
দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা ‘কিস্সাতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
আমার বয়স তখন সাত-আট বছর হবে। বাবা আমাকে শেখ হামিদ বিন আমহি নামে এক বেদুইনের কাছে শিকার শিখতে পাঠিয়েছিলেন। শেখ হামিদ অন্যান্য বেদুইনদের মতো পানির কাছাকাছি বাস করতেন না। তিনি থাকতেন তাঁবুতে। তার সঙ্গে তার স্ত্রীও থাকতেন। সেই সঙ্গে উট, বাজপাখি ও একটি শিকারি কুকুর সঙ্গী ছিল তার।
শৈশবের সেই সময়কার দিনগুলো আমি পরিষ্কার মনে করতে পারি। আমার মনে আছে শেখ হামিদের স্ত্রী জ্বালানির জন্য কিভাবে কাঠ সংগ্রহ করতেন, কিভাবে উটের দুধ দোয়াতেন। কিভাবে তিনি ভেড়া জবাই করতেন ও একা একা রান্না করতেন।
এমন কোনো কোনো দিন আসত যখন কোনো শিকার থাকত না। সেই দিনগুলোতে শেখ হামিদের স্ত্রী আমাদের জন্য তৈরি করে দিতেন ‘বেদুইন রুটি।’ কাঠকয়লা ও ছাইয়ের নীচে রান্না করা এক টুকরো মোটা রুটি। পরিষ্কার করার পরে এতে চর্বি ও মধু যোগ করা হতো। এর সাথে আমরা উটের দুধ পান করতাম। মরুভূমির শীতে ওই খাবার রীতিমতো বিলাসবহুল।
আমার বাবা কিছুদিনের জন্য শেখ হামিদের কাছে আমাকে রেখে যেতেন। তার কাছ থেকে আমি শিখতাম বাজপাখি ও কুকুরের সাহায্যে শিকার করা। বিভিন্ন প্রাণীর গতিবিধি ও চলাফেরার ধারা বুঝেছিলাম, তাদের লুকানোর কৌশল, কিভাবে হিংস্র প্রাণীরা অন্য প্রাণীদের শিকার করে, কীভাবে দুর্বলদের শিকার করতে হয় ইত্যাদি বিষয় তার কাছ থেকে রপ্ত করেছিলাম আমি।
যেমন: তিনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন যে খরগোশ যখন চড়ে বেড়ায় তখন তাকে ধরার চেষ্টা করা বৃথা। কারণ, খরগোশ খুব দ্রুত চলতে পারে। তবে দিনের শুরুতে বা দিনের শেষে খরগোশ শিকার করা সহজ। গ্রীষ্মে খরগোশ নিজের জন্য গভীর গর্ত খনন করে। শীতকাল হলো শিকারের মৌসুম। শীতকালে খরগোশগুলো বালিতে বা ঝোপঝাড়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখে।
ওই সময়টাই হলো শিকারের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। তবে খরগোশ খুব চালাক প্রাণী। তারা যেখানে বিশ্রাম নেয় সেখানে খুব সাবধানে যায়, যাতে তাদের পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করা না যায়। খরগোশ জানে, তাদের পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে কোনো বিপদ পৌঁছে যেতে পারে। ফলে তারা এমনভাবে চলে যে মরুভূমিতে সহজে তাদের পদচিহ্ন পড়ে না। কেবল বিশেষজ্ঞরাই এই পদচিহ্নগুলো বুঝতে পারেন।
আমি শেখ হামিদের কাছে বাজপাখি ও শিকারী কুকুর আর তাদের অভ্যাস সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। শেখ হামিদের কাছে আমি শিখেছি, একটি শিকারি কুকুরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় যে, সে একদিকে বুনো হরিণ শিকার করবে আবার অন্যদিকে বাড়িতে যে হরিণ আছে সেগুলোর দিকে তাকাবে না। হরিণকে ভেড়ার সাথে চরাণোও সম্ভব।
অনেকেই জানেন না কেন বেদুইনরা তাদের হাতে বাজপাখি রাখেন এবং হাতটাও কেন তারা এত উঁচুতে রাখেন। হাত উঁচুতে রাখার কারণ হলো বাজপাখি তার পাশের কোনো কিছুর চেয়ে কম উচ্চতায় থাকলে বিপদ অনুভব করে। বাজপাখির শত্রু হলো ঈগল।
শিকার করা ও শিকার শেখার পর আমরা রাতের খাবারের জন্য আগুনের পাশে বসতাম। সেখানে আলোচনা চলত। কখনো বিরক্তির ভাব আসত না।
দ্বিতীয় পর্ব: ইরানের রাজদরবার থেকে যে শিক্ষা নিয়েছিলেন দুবাই শাসক
শেখ হামিদের সঙ্গে আমার যে অভিজ্ঞতা ছিল তার বিশেষ একটা হয়েছে বিচ্ছু নিয়ে। অনেক রাতে বিচ্ছুর দংশনে ঘুম ভেঙেছে আমার। মনে হয়েছিল, বিচ্ছুগুলো আমার বিছানাতেও উষ্ণতার সন্ধানে এসেছিল। আমি খুব যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম থেকে উঠতাম। আর শেখ হামিদ আমাকে আগুনের কাছে নিয়ে যেতেন। বিচ্ছু যেখানে কামড় দিয়েছে সেই জায়াগায় ছাই দিয়ে দিতেন, যাতে বিষটি কমে যায়। ছাইয়ের উত্তাপ কামড়ের যন্ত্রণা কমাত। উত্তাপ কমতেই ব্যথা ফিরে আসত। তিন-চার বার এমন হয়েছে যে, প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে আমি ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। আমার অবাক লাগতো আমাকে একাই কেন বিচ্ছু কামড়ায়!
এর দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, আমি মরুভূমিতে ঘুমানোর আগে শেখ হামিদের বিছানা পরীক্ষা করার পরামর্শটি শুনতাম না। বিছানায় কী রয়েছে তা ঘুমানোর আগে ভালো করে দেখতাম না। দ্বিতীয়ত, শেখ হামিদ ১০ থেকে ১২ টি বিচ্ছু সংগ্রহ করে ইচ্ছাকৃতভাবে সেগুলো আমার বিছানায় রেখে দিতেন!
সেটা আমি অনেক দেরিতে বুঝতে পেরেছিলাম। শেখ হামিদ ছোট ছোট বিচ্ছুদের দিয়ে আমার ভেতরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজও আমার কাছে বিচ্ছুর বিষের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে।
হ্যাঁ, যা কষ্ট দেয় তার সবকিছুই আসলে খারাপ না। কষ্ট দেওয়া ঘটনাগুলো কখনও কখনও ভালো ফলও এনে দেয়।
কয়েক বছর আগে, আমি মরুভূমিতে একটি বড় বিচ্ছুর দংশনের শিকার হই। বিচ্ছুটি কয়েকটি ছোট গুল্মের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। আমি পা ফেলার সাথে সাথে আমাকে দংশন করে বিচ্ছুটি। আমার পা ফুলে গিয়েছিল। আমি তাতে কিছুটা ছাই এবং গরম পানি ঢালি। আমি বলতে পারি, আল্লাহর রহমত, আমার শরীরের শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা আর শেখ হামিদের শিক্ষায় আমি বেঁচে যাই।
এনএফ