ইন্দিরা গান্ধীর ঘাতকের ছেলে আর রাহুল গান্ধী, দুজনেই এবার সংসদে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে পাঞ্জাবের ফরিদকোট আসন থেকে জয়ী হয়েছেন সরবজিৎ সিং খালসা। তার অন্যতম পরিচয় হলো- তার বাবার নাম বিয়ন্ত সিং।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার যে দুজন দেহরক্ষী গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তাদেরই একজন ছিলেন বিয়ন্ত সিং। তার সঙ্গে একই লোকসভায় বসবেন ইন্দিরা গান্ধীর নাতি রাহুল গান্ধীও।
সরবজিৎ সিংয়ের মতোই আরেক খালিস্তানপন্থি নেতা অমৃতপাল সিংও এবারের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন জেলবন্দি অবস্থায় থেকেই। তার বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ আছে। ভোটে জেতার পরে তার আইনজীবীরা তার জামিনের ব্যবস্থা শুরু করেছেন।
অমৃতপাল সিংয়ের আইনজীবী রাজদেভ সিং খালসা সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, জামিনের আবেদনে অমৃতপাল সিংয়ের মাদক-বিরোধী অবস্থানটাকেই তুলে ধরবেন তারা। ভোটে জেতার পরে মানুষের সমর্থন যে অমৃতপাল সিংয়ের প্রতি আছে, সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
পাঞ্জাবের আম আদমি পার্টির সরকার এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাই অমৃতপাল সিংয়ের জামিনের বিরোধিতা না করতে বাধ্য হবে বলে মনে করেন খালসা।
আগেও মুখোমুখি সিং আর গান্ধী পরিবার
বিয়ন্ত সিংয়ের এবং ইন্দিরা গান্ধীর পরিবারের মুখোমুখি হওয়া অবশ্য এই প্রথম নয়। সরবজিৎ সিংয়ের মা তথা বিয়ন্ত সিংয়ের স্ত্রী বিমল কউর খালসা ১৯৮৯ সালে পাঞ্জাবের রোপার থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে জিতে সংসদে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধীও।
বিমল কউর খালসার রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় ১৯৯১ সালে। বিয়ন্ত সিংয়ের বাবা সুচা সিংও ভারতের পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছিলেন ভোটে জিতে। দাদু এবং মা শিরোমণি আকালি দলের হয়ে ভোটে জিতেছিলেন, সরবজিৎ সিং-ও সেই দলের হয়ে ভোটে লড়াই করে হেরে গিয়েছিলেন।
বার দুয়েক বিধানসভা ভোটেও লড়ে পরাজিত হন তিনি। তবে এবার তিনি জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তিনি খালিস্তানপন্থি হিসাবেই পরিচিত।
আবার আরেক খালিস্তানপন্থি নেতা অমৃতপাল সিংও পাঞ্জাব থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। তিনি জাতীয় সুরক্ষা আইনে জেলবন্দি হয়ে আছেন আসামের ডিব্রুগড়ে। জেল থেকেই ভোটে লড়ে জয়ী হয়েছেন অমৃতপাল সিং।
দুই খালিস্তানপন্থি নেতার ভোটে জয়ী হওয়া নিয়ে পাঞ্জাবে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচনী রাজনীতিতে খালিস্তানপন্থিদের উত্থানের বিষয়টি মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে বলে তারা মনে করছেন।
কেন খালিস্তানপন্থিদের উত্থান?
চণ্ডীগড়ের থিংকট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনের অধিকর্তা প্রমোদ কুমার মনে করেন, পাঞ্জাবের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের উদাসীনতাই খালিস্তানপন্থিদের জনপ্রিয়তা বাড়ার একটা কারণ।
জ্বলন্ত রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘গুরু গ্রন্থ সাহেব’ অপবিত্র করার সর্বশেষ যে ঘটনাগুলো হয়েছিল ২০১৫ সালে, সেগুলোর বিচার এখনও শেষ না হওয়া।
ওই ঘটনায় যে গণবিক্ষোভ হয়েছিল, পুলিশ সেখানে গুলি চালায় এবং দুজন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
আগেও বেশ কয়েকবার শিখদের ধর্মগ্রন্থ অপবিত্র করার ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে বিক্ষোভ এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু ২০১৫ সালে পরপর তিনবার গুরু গ্রন্থ সাহেব অপবিত্র করার ঘটনা সামনে আসে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই ঘটনাক্রম ও পুলিশের গুলি-চালনায় মৃত্যুর ফলে পাঞ্জাবের শিখ ধর্মাবলম্বীরা এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, দুবছর পরে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শিরোমণি আকালি দল ও বিজেপির জোট সরকারের পতন হয়।
প্রমোদ কুমারের কথায়, ‘ধর্মগ্রন্থ অপবিত্র করার ঘটনায় ন্যায় বিচার না পাওয়া এবং সেসব ঘটনায় যেসব শিখ বন্দির কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তারা মুক্তি না পাওয়ার বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। এর ফলেই অমৃতপাল সিং এবং সরবজিৎ সিং খালসাদের মানুষ ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন।’
তিনি বলছেন, ‘পাঞ্জাবের গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুগুলো মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। অনেক মিছিল-মিটিং করেছেন মানুষ, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এটা নিয়ে উদাসীনই থেকে গেছেন।’
তার ব্যাখ্যা, তাই মানুষ বিরক্ত হয়ে মূল ধারার রাজনৈতিক নেতাদের পরিবর্তে এমন সংসদ সদস্য বেছে নিলেন, যারা কিছুটা চরমপন্থি রাজনীতির কথা বলেন।
অবশ্য নির্বাচনের আগে সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঠিক এই বিষয়গুলোই উত্থাপন করেছিলেন বিয়ন্ত সিংয়ের পুত্র সরবজিৎ সিং।
‘ওয়ারিস পাঞ্জাব-দি’ এবং অমৃতপাল সিং
সরবজিৎ সিংয়ের মতোই যে আরেক খালিস্তানপন্থি নেতা এবার সংসদ সদস্য হয়েছেন, সেই অমৃতপাল সিংকে ‘ভিন্দ্রানওয়ালে ২.০’ বলে ডাকা হয়ে থাকে। জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে একজন শিখ ধর্মগুরু ছিলেন এবং তিনিই পৃথক খালিস্তানের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যা খালিস্তান আন্দোলন বলে পরিচিত।
কট্টরপন্থি শিখ ধর্ম-কেন্দ্র ‘দমদমি তাকশাল’এর জাঠেদার বা ধর্মগুরু ছিলেন ভিন্দ্রানওয়ালে। শিখদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৮৪ সালে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামের যে অভিযান চালিয়েছিল, সেই সময়েই গুলিযুদ্ধে নিহত হন ভিন্দ্রানওয়ালে।
ওই সেনা অভিযানের বদলা নিতেই সরবজিৎ সিংয়ের বাবা বিয়ন্ত সিং এবং তারই সহকর্মী সতওয়ান্ত সিং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিলেন।
কেন গ্রেপ্তার হন অমৃতপাল সিং?
পাঞ্জাবের মানুষ ২০২২ সালের আগে অমৃতপাল সিংয়ের নামই শোনেননি। অমৃতসরের কাছে জাল্লুপুর খেড়া গ্রামের এই যুবক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই বছর-দশেক আগে পরিবারের পরিবহন ব্যবসা দেখতে দুবাই পাড়ি দিয়েছিলেন। ভারতের পাসপোর্ট-ধারী হলেও তিনি কানাডারও পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট।
অমৃতপাল সিং ভারতে ফিরে আসেন ২০২২ সালে, আর সে বছরই ২৯ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব-দি’ সংগঠনের একটি গোষ্ঠী তাদের নতুন নেতা হিসাবে তাকে বেছে নেয়।
গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই অমৃতপাল সিংয়ের বেশ কয়েকশো সশস্ত্র অনুগামী অমৃতসরের কাছে আজনালাতে তাদের এক সহকর্মীকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশ থানায় আক্রমণ চালায়। হামলার সময় তাদের মুখে ছিল খালিস্তানের স্লোগান।
আগ্নেয়াস্ত্র ও কিরপান নিয়ে চালানো সেই হামলায় বহু পুলিশ কর্মী ও কর্মকর্তা আহত হন। পাঞ্জাব পুলিশ প্রায় এক মাস ধরে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। তাকে ধরার জন্য তারা এমন কী পাঞ্জাবের বেশ কিছু এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন
গ্রেপ্তারের পরে তাকে আসামের ডিব্রুগড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে আগে থেকেই বন্দি ছিলেন অমৃতপাল সিংয়ের কয়েকজন সহযোগী।
সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একাধিক সাক্ষাৎকারে ও বক্তৃতায় এই তরুণ নেতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি গুরু ভিন্দ্রানওয়ালের মতোই খালিস্তানের পক্ষে লড়ে যাবেন। তার ধর্মীয় বক্তৃতা শুনতে সভায় প্রচুর ভিড়ও হতো।
জেল থেকেই ভোটে লড়াই
সম্প্রতি নতুন করে যে খালিস্তানপন্থিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন, তাদের কাছে ‘হিরো’র মর্যাদা পান সদ্য সংসদ সদস্য হওয়া অমৃতপাল সিং। তিনি নিজে অবশ্য নিজে ভোটের প্রচারে নামতে পারেননি, কারণ তিনি সন্ত্রাস দমন আইনে অভিযুক্ত হয়ে আসামের ডিব্রুগড় জেলে আটক হয়ে আছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছর অমৃতপাল সিং এবং তার সহযোগীদের যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা নিয়েও মানুষের মনে ক্ষোভ আছে, যা ভোটযন্ত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। পরবর্তীতে পাঞ্জাব সরকার অমৃতপাল সিংয়ের অনেক সহযোগীকে মুক্তি দিলেও তাদের ওপরে হেফাজতে যে অত্যাচার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে, সেটাও মানুষের ক্ষোভের একটা কারণ।
মাদক-বিরোধী আন্দোলন
বিশ্লেষকরা বলছেন, অমৃতপাল সিং আর তার সহযোগীদের কেন সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার করা হলো, তা নিয়েও মানুষের মনে ক্ষোভ আছে। এই প্রশ্নও মানুষের মনে উঠেছে, অমৃতপাল সিং ও তার সহযোগীরা তো শিখ ধর্মের প্রচার করতেন আর মাদক বিরোধী কড়া অবস্থানও ছিল তাদের!
নির্বাচনে জয়ের পরেও অমৃতপাল সিংয়ের বাবা তারসেম সিং-ও বলেছেন, ‘আমাদের সব থেকে বড় লড়াইটা মাদকের বিরুদ্ধেই।’
মাদক সেবন পাঞ্জাবের সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অমৃতপাল সিং এই সমস্যার কথা তুলে ধরেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন কয়েক বছর আগে। নির্বাচনী প্রচারে অমৃতপাল সিংয়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাভাবনা তুলে না ধরে বরং মাদক-বিরোধী অবস্থানটাকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন তার সহকর্মীরা। বিবিসি বাংলা
টিএম