ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা এখন ১৪৫
গাজায় গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করা ইসরায়েলের যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের জন্য নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক দাবিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে। মঙ্গলবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া সর্বশেষ দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নরওয়ে, স্পেন এবং আয়ারল্যান্ড। ইউরোপের তিন দেশের এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমা শক্তিগুলোর ‘‘ফিলিস্তিনিরা কেবল ইসরায়েলের সাথে শান্তি আলোচনার অংশ হিসাবে রাষ্ট্রত্ব পেতে পারে’’ বলে দীর্ঘদিনের যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা ভেঙে দিয়েছে।
যদিও নরওয়ে, স্পেন এবং আয়ারল্যান্ডের ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার এই পদক্ষেপ ইসরায়েলকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা ১৪৫টিতে দাঁড়িয়েছে। আর এসব দেশের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশও রয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া এখনও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি।
এর আগে, গত এপ্রিলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্য রাষ্ট্র ঘোষণার এক পদক্ষেপে ভেটো দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র ঘোষণার ইতিবৃত্ত...
• ১৯৮৮ সাল: রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন ইয়াসির আরাফাত
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের সময় ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন।
আলজিয়ার্সে নির্বাসিত ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিষদের এক বৈঠকে এই ঘোষণা দেন তিনি। ওই বৈঠকে স্বাধীন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র পাশাপাশি বিদ্যমান থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে সেই ঘোষণার লক্ষ্য হিসাবে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে মেনে নেন পরিষদের নেতারা।
ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিষদের ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় আলজেরিয়া। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ, ভারত, তুরস্ক, আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও বেশ কয়েকটি মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশসহ আরও কয়েক ডজন দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
এরপর ২০১০ সালের শেষের এবং ২০১১ সালের শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া ঘিরে শুরু হওয়া সংকটের সময় আরও অনেক দেশ একের পর এক ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং চিলিসহ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রের দাবির প্রতি সমর্থনের আহ্বানে সাড়া দেয়। সে সময় অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাতে ইসরায়েলের নেওয়া পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় এসব দেশের স্বীকৃতি আসে।
• ২০১১-২০১২ : জাতিসংঘের স্বীকৃতি
২০১১ সালে শান্তি আলোচনা স্থগিত হওয়ার সাথে সাথে ফিলিস্তিনিরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়ার প্রচেষ্টা পুরোদমে শুরু করে। কিন্তু ওই সময় তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ সদস্য হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে ভোট দেয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের এই সংস্থায় অর্থায়ন স্থগিত করে। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে ইউনেস্কো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। পরে গত বছর পুনরায় ইউনেস্কে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২০১২ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে ‘‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’’ মর্যাদা দেওয়া হয়। এরপর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করা হয়।
এর তিন বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও (আইসিসি) ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে মেনে নেয়।
• ২০১৪: পশ্চিম ইউরোপের প্রথম দেশ সুইডেনের স্বীকৃতি
পশ্চিম ইউরোপের দেশ সুইডেনে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনির বসবাস রয়েছে। ২০১৪ সালে ইইউর সদস্য এবং পশ্চিম ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় সুইডেন। ইসরায়েল-অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে কয়েক মাস ধরে চলা সংঘর্ষের জেরে সেই সময় এই পদক্ষেপ নেয় দেশটি।
এর আগে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ইউরোপীয় ছয় দেশ— বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়া।
সেই সময় স্টকহোমের পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় ইসরায়েল। ইসরায়েলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভিগদোর লিবারম্যান সুইডিশদের বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্ক আইকিয়ার আসবাবপত্রের চেয়েও অনেক বেশি জটিল।
• ২০২৪: ইউরোপে নতুন উদ্যোগ
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে হামলা চালায় গাজার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী হামাসের শত শত যোদ্ধা। ওই দিন ইসরায়েলে এক হাজার ১৭০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করে হামাসের সদস্যরা। একই সঙ্গে আরও ২৫২ জনকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখে হামাস; যাদের মধ্যে এখনও ১২১ জন গাজায় জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মধ্যে অন্তত ৩৭ জন মারা গেছেন।
পরে ওই দিনই গাজা উপত্যকায় ব্যাপক যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সাত মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের যুদ্ধে গাজা উপত্যকায় ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে।
গাজায় নির্বিচারে ইসরায়েলি হামলা ও বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু ইউরোপে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করেছে। কয়েক মাসের সতর্কতার পর মঙ্গলবার নরওয়ে, স্পেন এবং আয়ারল্যান্ড ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো স্যানচেজ এই পদক্ষেপকে ‘‘ঐতিহাসিক সুবিচার’’ বলে অভিহিত করেছেন।
মাল্টা এবং স্লোভেনিয়াও সঠিক পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও বলেছেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির বিষয়টি আর ‘‘ফ্রান্সের জন্য নিষিদ্ধ’’ নয়। বরং অবশ্যই এটা ‘‘সঠিক মুহূর্তে’’ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এসএস