কলকাতায় এমপি আনোয়ারুল খুন: খণ্ডিত লাশের তথ্য নিয়ে ধোঁয়াশা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়ে নিখোঁজের ৮ দিন পর জানা গেছে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্লাটে তাকে খুন করা হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, ১২ মে কলকাতায় আসার পর নিখোঁজ হওয়া আনোয়ারুল আজীম আনারের খোঁজে তল্লাশি শুরুর পর বুধবার সকালে তার খুনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
প্রাথমিকভাবে এনডিটিভির প্রতিবেদনে আনোয়ারুল আজীমের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানিয়ে বলা হয়, সেখানে মরদেহের খণ্ডিত অংশ পাওয়া গেছে।
পরবর্তীতে এনডিটিভির ওই প্রতিবেদন থেকে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশি ওই এমপি খুন হয়েছেন বলে ধারণা করছে কলকাতা পুলিশ। তার মরদেহ কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে। তল্লাশি অভিযানের সময় নিউটাউনের একটি ফ্লাটে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছে পুলিশ।
এদিকে, কলকাতা পুলিশের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া একজন ক্যাবচালক জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হওয়া ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছে এবং মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ডিত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
যদিও পরবর্তীতে বিবিসি বাংলাও ক্যাব চালকের স্বীকারোক্তির তথ্য তাদের প্রতিবেদন থেকে সরিয়ে ফেলেছে।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে; সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সেখানে কাউকে এখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের সূত্র বলেছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন নারী। তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি।
এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, আনোয়ারুল আজীমের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কলকাতা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এর আগে, গত ২০ মে আজীমের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস কর্তৃপক্ষ এই তথ্য পেয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি উপ-দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
কলকাতার উত্তর শহরতলি বরাহনগর এলাকার সিঁথিতে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজীম, সেই গোপাল বিশ্বাস বলেছেন, ১৩ মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে ভাড়া করা গাড়িতে উঠেছিলেন আজীম, সেটির চালকের সন্ধান পেয়েছে বলে স্থানীয় পুলিশ তাকে জানিয়েছে।
‘‘পুলিশের কাছে আমি নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলাম। তারা ওই গাড়িটি খুঁজে বের করেছে আর চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই চালক নাকি পুলিশকে জানিয়েছেন যে সংসদ সদস্যের সঙ্গে একজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। তাদের দু’জনকে তিনি কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউন এলাকায় ছেড়ে দেন ১৩ মে।’’
২০ মে উপ-দূতাবাসের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসসচিব রঞ্জন সেন জানান, ‘‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সংসদ সদস্যের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জানানো হয় শনিবার। তারপরই আমরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা খোঁজখবর করছেন এমনটাই আমাদের জানানো হয়েছে।’’
আবার শেষবার যেহেতু নিখোঁজ সংসদ সদস্যকে কলকাতায় দেখা গিয়েছিল, তাই কলকাতা পুলিশের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখছিল বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস।
• ডাক্তার দেখাতে বের হয়ে নিখোঁজ
কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস এর আগে বলেছিলেন, আনোয়ারুল আজীমের সঙ্গে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে তার পারিবারিক সম্পর্ক। গোপাল বিশ্বাস বলেন, এবার তিনি এসে আমাকে বলেছিলেন যে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। কোন ডাক্তার ভালো হবে, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার জানাশোনা কোনো স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই, তাই আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সল্ট লেকের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে।
‘‘আমরা একসঙ্গে সকালের জলখাবার খেয়েছিলাম। তারপর এটাও তাকে বলেছিলাম যে আমার গাড়ি সেদিন নেই। তিনি যেন গাড়ির বন্দোবস্ত করে নেন। এরপর আমি বাড়ির একতলায় অফিসে চলে আসি।’’
গোপাল বলেন, ‘‘এরপর আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুপুরে বের হওয়ার সময়ে আমাকে বলে যান যে তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। তার খোঁজ না পাওয়ার পর আমি যখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখি, তখন জানতে পারি যে তিনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে।’’
আরও পড়ুন
বরাহনগর থানায় যে নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন গোপাল বিশ্বাস সেখানে তিনি লিখেছেন, তার বাড়ির অদূরে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়ার গাড়িটিতে ওঠেন আনোয়ারুল আজীম। তাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছেন, এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথাও পুলিশকে জানিয়েছেন গোপাল বিশ্বাস।
সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়িতে ফিরে আসার কথা থাকলেও সেখানে ফেরেননি আনোয়ারুল আজীম। হোয়াটসঅ্যাপে ১৩ মে তিনি মেসেজ পাঠান ‘‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করবে, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’’
• কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে বের হয়ে গেলেন দিল্লি?
কলকাতার গোপাল বিশ্বাসের গহনা রপ্তানির ব্যবসা আছে। তিনি বলেন, দুই-আড়াই দশকের বন্ধুত্ব সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের সঙ্গে। ‘‘বাংলাদেশে বিএনপির জমানায়ও ভারতে থাকত। আমাদের বাড়ি মাঝদিয়ায়। সেখানে সুভাষ আগারওয়ালের বাড়িতে থাকত আনার। আমার সঙ্গে সেখানেই পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক স্তরে চলে গেছে।
সে কারণেই চিকিৎসা করাতে এসে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজীম। সেদিন দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর. আজীম যে ভাড়ায় চালিত গাড়িতে উঠেছিলেন সেটির চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এরপর গোপাল বিশ্বাসকে পুলিশ জানিয়েছে, আজীমের সাথে আরেকজন বাংলাদেশি নাগরিককে নিউ টাউন অঞ্চলে ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ওই চালক।
এরপর ১৫ মে সকালে গোপাল বিশ্বাস আজীমের কাছ থেকে আবারও একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পান যে তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং তার সঙ্গে ‘ভিআইপিরা’ আছেন, তাই তাকে যেন ফোন করা না হয়। এর দু’দিন পর ১৭ মে গোপাল বিশ্বাসকে আজীমের মেয়ে ফোন করে জানান, তার বাবার সঙ্গে কিছুতেই তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না।
‘‘সে খবর জানতে পেরে কলকাতায় তার যত ঘনিষ্ঠ মানুষ আছেন বলে আমি জানি, সবাইকে বিষয়টা জানাই। তারাও খোঁজ খবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই আজীমকে ফোনে পাওয়া যায়নি,’’ বলেন গোপাল বিশ্বাস।
পরের দিন ১৮ মে বরাহনগর থানায় যান তিনি। গোপাল বলেন, সেখানে আমাকে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেসব খতিয়ে দেখে আমার নিখোঁজ ডায়েরি নেওয়া হয়। তারা ওই ভাড়ার গাড়িটির নম্বরও পেয়ে যায়। চালকের সঙ্গে কথা বলেছে। নিশ্চয়ই পুলিশ খোঁজখবর করছে, আমাকে তো আর সব তথ্য জানাচ্ছে না।’’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস যে তথ্য পেয়েছিল, সে অনুযায়ী ১৭ মে আজীমের মোবাইল নম্বরটি কিছুক্ষণের জন্য বিহারে অবস্থান করছিল। আবার এটাও জানা গেছে, মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটি আলাদা করে রাখার কারণে সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এর আগে, ঢাকায় ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘‘তার দু’টি বাংলাদেশি নম্বর আছে আর একটি ভারতের নম্বর। আমরা ভারতীয় পুলিশের সহযোগিতায় তার ভারতীয় নম্বরটি দেখলাম মুজাফফরাবাদ অর্থাৎ বিহারের দিকে।’’
ঘটনাচক্রে বিহারে মুজাফফরাবাদ নামে জায়গা নেই। পাকিস্তান শাসিত জম্মু-কাশ্মিরের রাজধানীর নাম মুজাফফরাবাদ। আর প্রায় কাছাকাছি যে নামের জায়গা বিহারে আছে, সেই জায়গার নাম মুজফ্ফরপুর।
ডিবি প্রধান সেদিন জানিয়েছেন, ‘‘আমরা বিষয়টার খোঁজখবর রাখছি। ভারতের যারা বাংলাদেশে আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলছি। আবার ভারতীয় পুলিশের সঙ্গেও কথা বলছি। উনার পরিবারও যোগাযোগ রাখছে আমাদের সঙ্গে। তার মেয়ে আমাদের কাছে এসেছিলেন।’’
সূত্র: এনডিটিভি, বিবিসি বাংলা।
এসএস