সন্দেশখালিতে ধর্ষণের অভিযোগ সাজানো, বিজেপি নেতার ভিডিওতে তোলপাড়
পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালির এক বিজেপি নেতার গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও সামনে এসেছে, যেখানে ওই নেতাকে বলতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে কোনও নারীই ধর্ষণের শিকার হননি এবং সেখানকার নারীরা এতদিন ধরে যে আন্দোলন করে আসছেন, সবটাই বিজেপির নেতারা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে নারীদের দিয়ে বলিয়েছেন।
সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতাদের দ্বারা ধর্ষণের অভিযোগ পুরোটাই সাজানো ঘটনা এবং এর পেছনে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এমনটাও উঠে এসেছে ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে।
এ নিয়ে শনিবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে।
বিজেপির যে নেতার ভিডিও গোপনে ধারণ করা হয়েছে, তার নাম গঙ্গাধর কয়াল। তিনি সন্দেশখালিতে বিজেপির দু নম্বর ব্লকের মন্ডল-সভাপতি। ওই সন্দেশখালি দু-নম্বর ব্লকের নারীরাই দলবদ্ধভাবে প্রতিবাদ শুরু করেন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
কয়ালের আরও একটি ভিডিও বার্তা সন্ধ্যায় এক্স (সাবেক টুইটার)-এ পোস্ট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারী, যেখানে কয়াল দাবি করেছেন, ওই স্টিং ভিডিওতে তার গলা বিকৃত করা হয়েছে উচ্চমানের কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
মূল স্টিং অপারেশনের ভিডিওটি ৩২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের। ভিডিওটি কারা করেছে তা স্পষ্ট নয় এবং সেটি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ইউটিউবে তৃণমূল কংগ্রেস যে পুরো ভিডিওটি দিয়েছে, সেখানে লেখা দেখা যাচ্ছে ‘সৌজন্যে: WILLIAMS-XY8YO’ ।
ইউটিউবে ওই চ্যানেলটিতে ৩ মে ভিডিওটি আপলোড করা হয়। ভিডিওটির শিরোনামে শুধু আপলোডের তারিখটি দেওয়া আছে। ভিডিওটির বর্ণনায়ও শুধু একটি লাইন ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘দেখুন কীভাবে কয়েকজন নেতা সন্দেশখালির সত্যকে বিকৃত করেছে’।
কী দেখা যাচ্ছে ভিডিওতে?
ভিডিওটি একটি কথোপকথনের। প্রশ্নকর্তাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গঙ্গাধর কয়ালের চেহারা স্পষ্ট।
ভিডিওটি শুরুর সেকেন্ড তিরিশেকের মাথায় প্রশ্নকর্তা বলছেন, ‘দাদা, তুমি জানো তোমরা কী লেভেলের কাজ করেছ! ধর্ষণ হয় নাই। তাকে ধর্ষণ বলে চালিয়েছ! তোমার বাড়ির বৌকে দিয়ে এই কাজ করাতে পারতে? আমরা তো পারব না। দাদা সেখানে বাইরের লোক হয়ে তাদের দিয়ে এই কাজ করিয়েছে। কী ভাবে ওদের ব্রেনওয়াশ করলে?’
এর উত্তরে গঙ্গাধর কয়ালকে হাসতে হাসতে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘শুভেন্দুদার নির্দেশেই আমরা এই কাজ করেছি। উনি আমাদের সাহায্য করেছেন। শুভেন্দুদা বলেছেন, এটা না করলে, তাবড় তাবড় লোকদের গ্রেপ্তার করানো যাবে না। আমরাও ওখানে দাঁড়াতে পারব না।’
এরপরে তার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে ‘গোটা বিষয়টি শুভেন্দুদা নিয়ন্ত্রণ করত?’
জবাবে গঙ্গাধর কয়াল বলছেন, ‘হ্যাঁ উনিই সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’
সন্দেশখালির নারীদের দিয়ে কীভাবে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ‘মিথ্যা’ অভিযোগ লেখানো হয়েছিল, কীভাবে তাদের শেখানো হয়েছিল, একবার শেখানোর পরেও কীভাবে অনেকে ভয়ে পিছিয়ে যায় মিথ্যা অভিযোগ লেখাতে, স্থানীয় বিজেপির আর কোন নেতা এর পেছনে ছিলেন, সেসব নামও বলেছেন কয়াল।
এক অভিযোগকারিনীর বাড়িতে যখন দিল্লি থেকে তপশিলি উপজাতি কমিশনের প্রধান এসেছিলেন, তার সামনে সেই নারী নাকি ‘ভয় পেয়ে গিয়েছিল’, কয়ালদের ‘ট্রেনিং’ দেওয়ার পরেও।
যাতে নারীদের মেডিক্যাল পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হলেও কেউ ধরা না পড়েন, তাই তাদের বলতে শেখানো হয়েছিল যে সাত-আট মাস আগে ধর্ষণ হয়েছিল। তিনি ওই স্টিং অপারেশনে এটাও বলেছেন, ‘প্রথমে রেখা অভিযোগ দায়ের করল। তার পর ওকে দেখে অন্য মহিলারাও অভিযোগ করার সাহস পেল।’
সন্দেশখালি যে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেখানে বিজেপির প্রার্থী রেখা পাত্র যে নিজে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সে কথা তার দল বারবার বলেছে। তিনি নিজে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও সে প্রসঙ্গে বলেছেন।
বর্তমানে গ্রেপ্তারকৃত সন্দেশখালির তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শেখ শাহজাহান, শিবপ্রসাদ হাজরা আর উত্তম সর্দারের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল।
আরও এক নারীর ভিডিও
স্টিং অপারেশনে আরও এক নারীর ভিডিও-ও আছে। তিনি স্টিং অপারেশনের প্রশ্নকর্তাকে বলছেন, ‘আমাকে বোঝানো ভুল হয়েছে। আমার কাছে কাগজটা আছে। আমি তো এত ইংরেজি জানি না। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি।’
আবার তিনি বলছেন, ‘ওখানে শাহজাহান, শিবু হাজরাদের কথা লেখা ছিল। আমি বুঝিনি। ওই কাগজে লেখা ছিল শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার আমাকে ধর্ষণ করেছে। সেটা আমাকে ভালো ভাবে বোঝানো হয়নি।’
নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ থেকে স্টিং অপারেশন এরপরে চলে গেছে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দিকে। কত পিস্তল, কার্তুজ লাগবে, কত অর্থ খরচ হবে, কত লোককে মদ খাওয়াতে হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ওই স্টিং ভিডিওতে।
তৃতীয় আরও এক ব্যক্তির ভিডিও-ও আছে এই স্টিং অপারেশনে। তার অংশটি অবশ্য খুবই ছোট। তিনি বিজেপির সন্দেশখালি এক নম্বর ব্লকের মন্ডল সভাপতি। স্টিং অপারেশনের ভিডিওর কিছু অংশ শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলনেও প্রদর্শন করেন তৃণমূল নেতা অভিষেক ব্যানার্জি।
তৃণমূল, বিজেপি যা বলছে
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আজ তার দুটি নির্বাচনী প্রচার সভাতে এই ভিডিও প্রসঙ্গ তুলেছেন। নদীয়ার জনসভা থেকে মমতা ব্যানার্জী বলেন, ‘ওরা সন্দেশখালি নিয়ে একটা নাটক করল। সত্যটা এবার সামনে এসেছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি যে এটা বিজেপির ষড়যন্ত্র।’
বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জী।
তিনি ওই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এই ষড়যন্ত্র বাংলা এবং পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্র দুই হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলার নারীদের সম্ভ্রম বিক্রি করে দিয়েছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমা না চায়, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে তাদের মদতেই এই ষড়যন্ত্র হয়েছিল।’
অন্যদিকে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, যে ভিডিওটি প্রকাশ্যে এসেছে, তা ‘বিকৃত’। এই অভিযোগ জানিয়ে সিবিআইয়ের ডিরেক্টরকে ই-মেইল পাঠিয়েছেন বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়াল।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘গঙ্গাধর কয়ালের সঙ্গে সন্দেশখালি আন্দোলনের কোনও যোগাযোগ ছিল না। একটা ভিডিও এনে রাজনীতি বদল সম্ভব নয়। বিরোধী দলনেতাকে কালিমালিপ্ত করতে এটা ঘটানো হয়েছে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তৃণমূল আসলে সন্দেশখালির নির্যাতিতাদেরই অপমান করল।’
নারী নির্যাতন নিয়ে বিজেপির প্রচার
সন্দেশখালিতে নারীদের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই তা নিয়ে সরব হয়েছিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার পশ্চিমবঙ্গে এসে সন্দেশখালি নিয়ে কথা বলেছেন।
সন্দেশখালির বিষয়টি শুধুমাত্র ওই বসিরহাট লোকসভা আসনে সীমাবদ্ধ না রেখে সেখানকার নারীদের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রচারে নিয়ে গেছে বিজেপি।
তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে অনেকেই গত কয়েক মাসে যে শেখ শাহজাহানসহ তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে জমি জবরদখলের অভিযোগ থাকলেও নারী নির্যাতন নিয়ে চুপ থাকতেন।
আবার সেখানকার প্রতিবাদী নারী হিসাবে যারা মুখ ঢেকে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেন, তারা গোড়ার দিকে নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারতেন না যে, ঠিক কোন নারী ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তবে নির্বাচনের মৌসুমে কয়েক সপ্তাহ আগে সন্দেশখালিতে কয়েকজন তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক নারী বিবিসি সংবাদদাতার কাছে বলেছিলেন, নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের কোনও ঘটনাই সেখানে ঘটেনি।
আর কয়েকজন পুরুষ বাসিন্দা বলেছিলেন, জমি দখল করেছিল শেখ শাহজাহানের দলবল, কিন্তু নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলো সঠিক নয়। কিন্তু সেকথা তারা প্রকাশ্যে বলতে পারেন না, ‘ভয় আছে’ বলে। বিবিসি বাংলা
টিএম