হাসপাতাল ছাড়লেন বিশ্বে প্রথম শূকরের কিডনি নেওয়া সেই রোগী
শূকরের কিডনিতে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে তা প্রতিস্থাপন করা বিশ্বের প্রথম সেই রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে (এমজিএইচ) ওই রোগীর শরীরে শূকরের সফল কিডনি প্রতিস্থাপনের দুই সপ্তাহ পর বুধবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসকরা এই ঘটনাকে যুগান্তকরী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
কয়েক দশক ধরে চিকিৎসকরা চেষ্টা চালালেও মানুষের শরীরে শূকরের কিডনি কাজ করেনি। বরং মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেম তাৎক্ষণিকভাবে অন্য প্রাণীর টিস্যু ধ্বংস করে ফেলে। সম্প্রতি শূকরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিয়ে মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের বেশ কিছু প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়ার আগে জিনগত পরিবর্তন এনে শূকরের জন্ম দেওয়া হয়; যাতে তাদের অঙ্গগুলো মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো হয়।
এখন পর্যন্ত শূকরের কিডনিতে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে তা মানবদেহে প্রতিস্থাপনের এই পদ্ধতির সাফল্যকে বিজ্ঞানীরা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ‘‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’’ বলে অভিহিত করেছেন। বুধবার এমজিএইচ কর্তৃপক্ষ তাদের অভূতপূর্ব এই সাফল্যের তথ্য শেয়ার করেছে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অবস্থিত হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমজিএইচ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রিচার্ড ‘‘রিক’’ স্লেম্যান নামের ম্যাসাচুসেটসের ওয়েমাউথের বাসিন্দা কিডনি রোগের শেষ স্তরে লড়াই করছিলেন। তার একটি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা প্রয়োজন ছিল। গত ১৬ মার্চ ৬২ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির শরীরে চার ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার করে কিডনিটি প্রতিস্থাপন করেন একদল চিকিৎসক। তারা বলেছেন, স্লেম্যানের কিডনি এখন ভালোভাবে কাজ করছে এবং তিনি আর ডায়ালাইসিসে নেই।
এক বিবৃতিতে স্লেম্যান বলেছেন, হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে যেতে পারাটা তার জীবনের ‘‘সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলোর একটি’’।
‘‘আমি অনেক বছর ধরে আমার জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করে এমন ডায়ালাইসিসের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানোর জন্য মুখিয়ে আছি।’’
এর আগে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে স্লেম্যানের একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর তার সেই কিডনিটি বিকল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। পরে ডায়ালাইসিস নেওয়া শুরু করেন তিনি। ডায়ালাইসিসের কারণে শরীরে জটিলতা তৈরি হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন।
বোস্টনের চিকিৎসকরা বলেছেন, তারা শূকরের একটি কিডনিতে জিনগত পরিবর্তন এনে স্লেম্যানের শরীরে তা প্রতিস্থাপন করেছেন। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল বলেছে, বিশ্বে তারাই প্রথমবারের মতো শূকরের কিডনি জীবিত মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করেছে।
স্লেম্যান বলেন, ‘‘আমি এটাকে কেবল আমার নিজেকে সহায়তার উপায় হিসেবে দেখছি না। বরং এটা হাজার হাজার মানুষকে আশান্বিত করার একটি উপায়; যাদের বেঁচে থাকার জন্য কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রয়োজন।’’
স্লেম্যানের নেওয়া নতুন শূকরের কিডনিটিতে জিনগত পরিবর্তন এনেছে কেমব্রিজ-ভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ইজেনেসিস। তারা কিডনিটি থেকে শূকরের ক্ষতিকর জিন অপসারণ এবং মানুষের শরীরের সাথে মানিয়ে নিতে পারে এমন কিছু মানব জিন বসিয়ে ট্রান্সপ্ল্যান্টের উপযোগী করে তোলে বলে জানিয়েছে।
মানবদেহে অঙ্গপ্রতঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘাটতি মেটাতে বহুকাল ধরেই শূকরের অঙ্গ নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু শূকরের শরীরের কোষে বিশেষ এক ধরনের সুগার রয়েছে; যা মানবদেহের কাছে আগন্তুক হিসেবে শনাক্ত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে মানবদেহ তা প্রত্যাখ্যান করে। যে কারণে কিডনি প্রতিস্থাপনের এই পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকরা জিন-সম্পাদনা করে শূকরের জন্ম দেন। জিন সম্পাদনা করে শূকরের শরীর থেকে সেই সুগার ফেলে দেওয়া হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে আক্রান্ত না হয় সেজন্য শূকরের জিন সম্পাদনা করা হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এই প্রক্রিয়ায় তারা ১৯৫৪ সালে বিশ্বের প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপনের পেছনের ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এর পাশাপাশি গত পাঁচ বছর ধরে জেনোট্রান্সপ্ল্যান্টেশন নিয়ে ইজেনেসিসের সাথে গবেষণাও চালিয়েছিলেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এই প্রক্রিয়ায় সফল কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের নেপথ্যে থাকা চিকিৎসক দল এই ঘটনাকে ‘‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারা বলেছেন, বিশ্বের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ঘাটতির সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারে এটি। বিশেষ করে জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়; যারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছেন।
এমজিএইচ হাসপাতালে স্লেম্যানের চিকিৎসক উইনফ্রেড উইলিয়ামস বলেছেন, ‘‘এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রচুর সরবরাহ শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসমতা অর্জনে এবং কিডনি বিকল রোগীদের সর্বোত্তম সমাধানে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে।’’
আরও পড়ুন
অলাভজনক মার্কিন সংস্থা ইউনাইটেড নেটওয়ার্ক ফর অর্গান শেয়ারিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক লাখের বেশি আমেরিকানের জীবন রক্ষাকারী এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। কিন্তু গত বছর দেশটিতে মৃত এবং জীবিত দাতার সংখ্যা ২৩ হাজার ৫০০ জনেরও কম ছিল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক দিন ১৭ জন রোগী মারা যান বলে ধারণা করা হয়। আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে কিডনির।
এটি মানুষের শরীরে প্রথমবারের মতো শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘটনা। তবে শূকরের অন্যান্য অঙ্গ মানব শরীরে প্রতিস্থাপন অতীতেও করা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে শূকরের একটি কিডনি ‘‘ব্রেইন-ডেড বা ক্লিনিক্যালি ডেড’’ একজন মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এছাড়াও শূকরের হৃদযন্ত্র দু’জন পুরুষের শরীরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছিল। যদিও হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের কয়েক মাসের মধ্যেই তারা মারা যান।
এর আগে, ২০২১ সালের অক্টোবরে নিউইয়র্কের একদল চিকিৎসক মানবদেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করে অনন্য এক সফলতা পান। তবে সেটি করা হয়েছিল ‘‘ক্লিনিক্যালি ডেড’’ ঘোষণা করা এক নারীর শরীরে। একদিন জীবন-রক্ষাকারী কিডনি প্রতিস্থাপনে মানুষের শরীরে প্রাণীর কিডনি সফলতার মুখ দেখবে বলে গত কয়েক দশক ধরে চিকিৎসকরা যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন; নিউ ইয়র্কের চিকিৎসকরা সেই প্রচেষ্টায় প্রথম সফলতা পান।
সূত্র: বিবিসি, এপি।
এসএস