তুরস্কে সত্যিই কী নূহ নবীর সেই নৌকার সন্ধান পাওয়া গেছে?
হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকার গল্পকে সবচেয়ে বেশি চর্চিত ধর্মীয় গল্পগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, এই গল্প শোনেননি এমন লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছেন।
সেমেটিক ধর্মবিশ্বাসীদের মতে, নূহ (আ.) বা নোয়াহ ছিলেন একজন নবী, যাকে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকে সেমেটিক ধর্ম বলা হয়।
এসব ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে নূহ (আ.) এমন একটি নৌকা বানিয়েছিলেন, মহাপ্লাবনের সময় যেটিতে আশ্রয় নিয়ে মানুষ ও পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণিকূল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল।
কিন্তু মহাপ্লাবনের পর বিশাল আকৃতির সেই নৌকার পরিণতি ঠিক কী হয়েছিল? সেটির অস্তিত্ব কি এখনও টিকে আছে? যদি টিকে থাকে, তাহলে নৌকাটি ঠিক কোথায় রয়েছে?- এমন নানান প্রশ্ন শত শত বছর ধরে মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে অনুসন্ধানও কম চালানো হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান চালানো হয়েছে তুরস্কের আরারাত পর্বতে, যেটির উচ্চতা পাঁচ হাজার মিটারেরও বেশি। কারণ মহাপ্লাবনের পর এই পর্বতেই নূহ (আ.)-এর নৌকা নোঙর ফেলেছিল বলে খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সময় সেখানে নূহ (আ.)-এর নৌকা খুঁজে পাওয়ার দাবিও করেছেন অনেকে। যদিও তাদের কেউই নিজেদের দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
তবে সম্প্রতি গবেষকদের একটি দল দাবি করেছেন, তুরস্কে তারা অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগের বিশাল একটি নৌকার ‘ধ্বংসাবশেষ’ খুঁজে পেয়েছেন। এটি নূহ (আ.)-এর নৌকার ধ্বংসাবশেষ বলেই ধারণা করছেন তারা।
মহাপ্লাবন ও নূহ (আ.)-এর নৌকা
খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেল এবং মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ আল কোরআনে নূহ (আ.)-এর নৌকা বানানোর প্রেক্ষাপট ও মহাপ্লাবনের প্রায় একই ধরনের দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়। খ্রিস্টান পণ্ডিতদের মতে, নূহ (আ.) ছিলেন আদমের বংশের দশম উত্তরাধিকারী।
মহাপ্লাবনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বাইবেলের আদি পুস্তক ‘দ্য বুক অব জেনেসিসে’ বলা হয়েছে, আদমের মৃত্যুর অনেক বছর পর পৃথিবীর মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়ে হানাহানি ও অন্যান্য খারাপ কাজে লিপ্ত ছিল।
তাদেরকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য সৃষ্টিকর্তা নূহ (আ.)-কে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার অধিকাংশ মানুষই নূহ (আ.)-এর দেখানো পথে হাঁটেনি। এমন পরিস্থিতিতে সৃষ্টিকর্তা সিদ্ধান্ত নিলেন, এক মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে তিনি বিপথগামীদের ধ্বংস করে দিবেন।
এরপর নূহ (আ.)-কে বড় আকৃতির একটি নৌকা বানাতে বলা হয়। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, লম্বায় নৌকাটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় পাঁচশ ফুট। গফার বা সাইপ্রাস গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকাটির তিনটি আলাদা তলা এবং একটি দরজা ছিল।
বানানোর পর নৌকাটির ভেতরে ও বাইরে পিচ লাগানো হয় যেন পানিতে কাঠ নষ্ট হয়ে না যায়। এরপর পশু ও পাখির মধ্য থেকে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রতিটির সাতটি করে জোড়া নৌকাটিতে তোলা হয়।
এছাড়া শূকর, ইঁদুর, বাদুড়ের মতো নোংরা প্রাণিগুলোর একটি করে জোড়া তোলা হয়। নোংরা প্রাণী বলতে সেসব প্রাণীকে বোঝানো হয়েছে, যেগুলোর পালন ও মাংস খাওয়ার ব্যাপারে বাইবেলের আদি গ্রন্থে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
জোড়ায় জোড়ায় পশু-পাখি তোলার পর নূহ (আ.) তার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে নৌকায় ওঠেন। এরপর সৃষ্টিকর্তা নৌকার দরজা বন্ধ করে দেন। দ্য বুক অব জেনেসিসের বর্ণনা অনুযায়ী, তিন তলা নৌকার নিচতলায় জন্তু-জানোয়ার, দোতলায় মানুষ এবং ওপরের তলায় পাখিদের রাখা হয়।
এরপর শুরু হয় মহাপ্লাবন। প্রায় ৪০ দিন এবং ৪০ রাত ধরে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়। তখন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়া না ডোবা পর্যন্ত পানি বাড়তে থাকে বলে বাইবেলের বর্ণনায় উঠে এসেছে।
এই মহাপ্লাবন ১৫০ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ফলে নূহ (আ.)-এর নৌকার বাইরে পৃথিবীর আর কোথাও কোনও প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না বলে বাইবেলে বলা হয়েছে। পাঁচ মাস পর পানি কমতে শুরু করে। এরপর নূহ (আ.)-এর নৌকা আরারাত পাহাড়ে অবস্থান নেয়।
পানি সরে গিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনও ভূমি জেগে উঠেছে কি না, সেটি দেখতে প্রথমে একটি কাক, তারপর একটি কবুতর পাঠান নূহ (আ.)। কিন্তু কোথাও কোনো শুষ্কভূমি না পেয়ে সেগুলো পুনরায় নৌকায় ফিরে আসে।
সাতদিন পর আবারও একটি কবুতর ছেড়ে দেওয়া হয়, যেটি পরবর্তীতে ঠোঁটে একটি সতেজ জলপাই পাতা নিয়ে ফিরে আসে। এটি দেখে নূহ (আ.) বুঝতে পারেন, ভূমি জাগতে শুরু করেছে।
সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে এরপর নূহ (আ.) তার পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকা থেকে বের হয়ে আসেন। এছাড়া পশু-পাখিদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হয় বলে বাইবেলে বলা হয়েছে।
মুসলমানদের ধর্মীয়গ্রন্থ আল কোরআনেও ঘটনাটিকে প্রায় একইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বাইবেলের বর্ণনায় যেখানে প্রতিটি পশু-পাখির সাতটি করে জোড়া নৌকায় তোলার কথা বলা হয়েছে, সেখানে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে একটি করে জোড়ার কথা।
এছাড়া দেড়শ দিন ভেসে বেড়ানোর পর নূহ (আ.)-এর নৌকাটি জুদি নামের একটি পর্বতে নোঙর ফেলে বলে কোরআনের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামি পণ্ডিতদের অনেকেই মনে করেন, জুদি পর্বতটি তুরস্কের আরারাত পর্বতমালারই একটি অংশ।
যদিও ধর্মীয় গ্রন্থে বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবনের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে সেরকম কোনও ঘটনার প্রমাণ অবশ্য এখনও পাননি বিজ্ঞানীরা। তারপরও ধর্মীয় কারণে কিংবা ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে অনুসন্ধিৎসু মনের কৌতুহল মেটানোর উদ্দেশ্যে এখনও অনেকে নূহ (আ.)-এর নৌকার খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুগে যুগে অনুসন্ধানের চেষ্টা
প্রাচীনকাল থেকেই নূহ (আ.)-এর নৌকার অনুসন্ধান চলছে। ইহুদিদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ তালমুদে উল্লেখ করা হয়েছে, আসেরীয় রাজা সেন্নাকেরিব খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে নূহ (আ.)-এর নৌকার খোঁজে জুদি পর্বতে উঠেছিলেন।
তিনি সেখানে নৌকার একটি কড়িকাঠ খুঁজে পেয়েছিলেন বলেও গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে। এছাড়া খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের দিকেও যে মানুষ নূহ (আ.)-এর নৌকার অনুসন্ধান করছিলেন, সেটি জানা যায় তৎকালীন ইতিহাসবিদ ইউসেবিয়াসের গ্রন্থ থেকে।
এরপর খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের ইতিহাসবিদ ফস্টাস তার ‘হিস্ট্রি অব দ্য আর্মেনিয়ানস’ গ্রন্থে সেন্ট জ্যাকব নামের একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজককে ঘিরে তৈরি হওয়া একটি লোককাহিনীর উল্লেখ করেছেন।
সেই লোককাহিনীতে বলা হয়েছে, নূহ (আ.)-এর নৌকার সন্ধানে সেন্ট জ্যাকব আরারাত পর্বতে উঠেছিলেন। তিনি যখন চূড়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন, তখন একজন স্বর্গীয় দূত তার স্বপ্নে এসে পর্বতের মাথায় উঠতে নিষেধ করেন।
সান্ত্বনাস্বরূপ সেই স্বর্গীয় দূত সেন্ট জ্যাকবকে নূহ (আ.)-এর নৌকার একখণ্ড কাঠ এনে দেন। সেই কাঠ নিয়ে জ্যাকব শহরে ফিরে আসেন, যা এখনও আর্মেনিয়ার একটি প্রাচীন গির্জায় সংরক্ষিত রয়েছে বলে খ্রিস্টানদের অনেকেই বিশ্বাস করেন।
তবে কাগজপত্রে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আরারাত পর্বতে ওঠার ক্ষেত্রে যার নাম পাওয়া যায়, তিনি হচ্ছেন বাল্টিক-জার্মান প্রকৃতিবিদ ও পর্বতারোহী ফ্রেডরিখ প্যারোট। ১৮২৯ সালে তার নেতৃত্বে একটি দল প্রথম এই পর্বতের চূড়ায় আরোহন করে।
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘জার্নি টু আরারাত’ গ্রন্থে প্যারোট লিখেছেন, আর্মেনিয়ার মানুষরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নূহ (আ.)-এর নৌকাটি এখনও আরারাত পর্বতের চূড়ায় রয়েছে। তারা এটাও বিশ্বাস করে, সংরক্ষণের স্বার্থেই নৌকাটির কাছে কোনও মানুষকে যেতে দেওয়া হবে না।
এরপর ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ গবেষক ও রাজনীতিবিদ জেমস ব্রাইস আরারাত পর্বতে আরোহন করেন। তিনি দাবি করেছিলেন, পর্বতে তিনি চার ফুট লম্বা ও পাঁচ ইঞ্চি পুরু একটি কাঠের টুকরো দেখতে পেয়েছেন, যেটি কোনো একটি হাতিয়ার দিয়ে কাটা হয়েছে।
১৯৪০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রকাশিত নিউ ইডেন নামের একটি পুস্তিকায় ‘নূহের নৌকা পাওয়া পাওয়া গেছে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভ্লাদিমির রোস্কোভেটস্কি নামের রাশিয়ার একজন বৈমানিক আরারাত পর্বতের ওপর দিয়ে বিমান চালিয়ে যাওয়ার সময় একটি হ্রদ দেখতে পান।
সেই হ্রদের তীরে তিনি একটি বিশাল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখেতে পেয়েছিলেন বলেও নিবন্ধটিতে দাবি করা হয়।
এরপর ১৯৫৯ সালে তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনীর একটি বিমান নিয়ে আরারাত পর্বত অঞ্চলে ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন ইলহান দুরুপিনার। তখন আরি প্রদেশের দোবায়েজিত এলাকায় তিনি ‘নূহ (আ.)-এর নৌকা’র মতো দেখতে একটি অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখেছেন বলে দাবি করেন।
এ ঘটনার পর কথিত নূহ (আ.)-এর নৌকার ধ্বংসাবশেষকে দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ওই এলাকায় ভিড় করতে শুরু করেন। জায়গাটি ‘দুরুপিনার সাইট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। গবেষকরাও বিভিন্ন সময়ে সেখানে অনুসন্ধান অভিযান চালিয়েছেন।
এটি করতে গিয়ে কেউ কেউ নিখোঁজও হয়েছেন। তেমনই একজন হচ্ছেন ডোনাল্ড ম্যাকেঞ্জি। স্কটল্যান্ডের নাগরিক ম্যাকেঞ্জি ২০১০ সালে নূহ (আ.)-এর নৌকার অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিখোঁজ হন।
‘ধ্বংসাবশেষ’ পাওয়ার দাবি
আরারাত পর্বতের দুরুপিনার সাইটে খননকাজ চালিয়ে অন্তত পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো বিশাল আকৃতির একটি নৌকার ‘ধ্বংসাবশেষ’ খুঁজে পেয়েছেন বলে সম্প্রতি দাবি করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল।
এটি নূহ (আ.)-এর নৌকার ধ্বংসাবশেষ বলেই ধারণা করছেন তারা। ‘মাউন্ট আরারাত অ্যান্ড নোয়াহ’স আর্ক রিসার্চ টিম’ নামের ওই গবেষক দলটি ২০২১ সালে কাজ শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্ড্রুস ইউনিভার্সিটির সাথে ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং আরি ইব্রাহীম চেচেন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা যৌথভাবে দলটি গঠন করেন। যেখানে নৌকার ‘ধ্বংসাবশেষ’ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালে সেখানকার অন্তত ত্রিশটি শিলা ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
এরপর এক বছর ধরে সেগুলোর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষার প্রাথমিক ফলাফলে নমুনাগুলোর মধ্যে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো কাদামাটির উপকরণ, সামুদ্রিক উপকরণ ও সামুদ্রিক খাবারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
সম্প্রতি তুরস্কের গণমাধ্যম হুরিয়েতকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক ফারুক কায়া বলেছেন, ‘এটি থেকে স্পষ্ট হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০০ থেকে ৩০০০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল। প্রাথমিকভাবে এটি নূহ (আ.)-এর নৌকার ধ্বংসাবশেষ বলেই মনে হচ্ছে।’
তবে আসলেই সেটি নূহ (আ.)-এর নৌকা কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও অনেকদিন গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
‘প্রাথমিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এটি জোর দিয়ে বলা যাবে না, নৌকাটি এখানেই রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের আরও অনেক দিন কাজ চালিয়ে যেতে হবে,’ বলেন অধ্যাপক কায়া।
মিথ নাকি সত্যি?
বাইবেল ও আল কোরআনে মহাপ্লাবনের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেটির সাথে বেশ কিছু সভ্যতার কিংবদন্তির মিল পাওয়া গেছে। অতিপ্রাকৃত শক্তিসম্পন্ন দেবতার নির্দেশে প্রলয়ের মাধ্যমে সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার এমন বিবরণ রয়েছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার একাধিক গ্রন্থে।
খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর আগে লেখা গিলগামেশের মহাকাব্য থেকে শুরু করে ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বের ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে প্রলয়ের সময় নৌকা বানানোর ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
বস্তুত টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর এলাকাটি মাঝে মধ্যেই প্লাবিত হতো। মিশরের নীল নদের তীরবর্তী অঞ্চলও প্রায় প্রতি গ্রীষ্মেই বন্যার কবলে পড়তো, যার ফলে মিশরীয়দের কৃষিজমি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
এছাড়া চীন ও কৃষ্ণসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলেও প্রাচীনকালে মাঝে মধ্যে বন্যা হতো বলে জানা যায়। এসব এলাকার বন্যার প্রাচীন কাহিনীগুলো পর্যালোচনা করলে প্রায় একই ধরনের কারণ পাওয়া যায়।
সেখানে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তা বা অতিপ্রাকৃত শক্তিসম্পন্ন কোনো দেবতা হয় ‘শাস্তিস্বরূপ’, না হয় সব ধ্বংস করে দিয়ে ‘নতুন করে শুরু করার জন্য’ বন্যা পাঠিয়েছেন। মহাপ্লাবনের এই পৌরাণিক কাহিনী কি বাস্তব ঘটনাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে?
‘প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে একটি বড় বন্যা হয়েছিল বলে ভূতাত্ত্বিক কিছু প্রমাণ রয়েছে,’ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ এরিক ক্লাইন।
অবশ্য বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত নন। তাছাড়া সেই যুগের ইতিহাসবিদেরা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রলয় সম্পর্কে লিখেছে কি না, সেটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, প্লাবনের ঘটনাগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে হয়েছিল। কালক্রমে সেই ঘটনাগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মৌখিক এবং লিখিত ইতিহাসে ঢুকে পড়েছে বলেও ধারণা তাদের।
যদিও বিভিন্ন সময়ে যারা আরারাত পর্বতে উঠেছেন, তাদের অনেকেই সেখানে নূহ (আ.)-এর নৌকার ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-প্রমাণ না থাকায় সেসব দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
‘স্বীকৃত কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ এমন দাবি করেনি, তারা নৌকাটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে,’ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার প্রত্নতত্ত্ববিদ জোডি ম্যাগনেস।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব গুপ্তধন খোঁজ করার মতো কোনো বিষয় নয়। এটি কোনো নির্দিষ্ট বস্তুকে খুঁজে বের করার মতোও কোনো বিষয় নয়। বরং প্রত্নতত্ত্ব এমন একটি বিজ্ঞান যেখানে আমরা গবেষণার উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন নিয়ে হাজির হই এবং আশা করি, খনন কাজের মাধ্যমে সেগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে।’
প্রত্নতত্ত্ববিদরা এসব কথা বললেও যারা সেমেটিক ধর্ম মানেন, তাদের অনেকে এখনও বিশ্বাস করেন, নূহ (আ.)-এর সময় মহাপ্লাবনের ঘটনাটি সত্যি সত্যিই ঘটেছিল এবং নৌকা তৈরি করা হয়েছিল।
এক্ষেত্রে বাইবেল ও আল কোরআনে উল্লেখিত মহাপ্লাবনের বিবরণকে তারা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন।
আর যারা এসব মানেন না, তাদের কাছে নূহ (আ.)-এর নৌকা ও মহাপ্লাবনের ঘটনাটি নিছক একটি কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, ঘটনাটির বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো ব্যাখ্যা বা প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। বিবিসি বাংলা
টিএম