ইমরান খান: ভোটে অযোগ্য, দোষী সাব্যস্ত কিন্তু রাজনীতির বাইরে নন
ইমরান খানের প্রথম আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। সেসময় তার মা শওকত খানম একজন পীরনিকে (মহিলা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক) তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং তার একমাত্র ছেলেকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি আশা করেছিলেন, পীরনি হয়তো ইমরানের জন্য প্রার্থনা করবেন এবং কিছু দিকনির্দেশনা দেবেন। কিন্তু তার (ইমরান) জন্য প্রার্থনা করার পরিবর্তে, পীরনি ইমরানের মায়ের সামনে একটি সত্য উন্মোচন করে কার্যত চমকে দিয়েছিলেন — যে সত্যটি শুধুমাত্র ইমরান বা তার ক্বারী সাহেবের জানা ছিল — যে তার ছেলে এখনও পবিত্র কোরআন খতম দিতে পারেনি।
ছোট বয়সের সেই ইমরান হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কারণ পীরনি সত্য কথাই বলেছিলেন। ইমরানকে কোরআন শেখাতে আসা ক্বারী সাহেবই শুধুমাত্র জানতেন যে, তার ছাত্র এখনও কোরআন খতম করেনি। স্কুল ছুটি শেষে বাসায় কোরআন পড়ার পরিবর্তে ইমরান সেসময় লাহোরের জামান পার্কে ক্রিকেট খেলায় মগ্ন থাকতেন। কারণ ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অনেক বেশি।
ইমরান তুখোড় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি দরিদ্র ক্বারী সাহেবকে তার মায়ের কাছে মিথ্যা বলতে বাধ্য করেছিলেন যে, তিনি ইতোমধ্যেই কোরআন খতম করেছেন। আর তাই সত্যটা সামনে উন্মোচন করে দেওয়ার পরও ইমরান কখনোই পীরনির বিরোধিতা করেননি এবং সত্য শুনে ইমরানের মা হতাশ হয়েছিলেন। তবে পীরনি ইমরানের মাকে চিন্তা না করতে বলেছিলেন। তিনি শওকত খানমকে বলেছিলেন, তার ছেলে খুব ভালো এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো হয়ে উঠবে।
ইমরান খান তার জীবনীতে এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। ইমরানের বয়স যখন ষাট বছরের বেশি তখন তিনি আরেকজন পীরের সাথে দেখা করেন এবং তাকে চুপচাপ বিয়ে করেন। প্রথম দিন থেকেই সেই বিয়ের সময়কে ঘিরে ছিল অনেক গুঞ্জন।
তার (ইমরানের) কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে বলেছেন, তিনি বুশরা বিবিকে বিয়ে করেছিলেন কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, তাকে বিয়ে করলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। সেই বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে ইমরান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি কখনোই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য একজন নারীকে বিশ্বাস করেছিলেন যিনি পিঙ্কি পীরনি নামে সুপরিচিত ছিলেন।
সারাজীবন ইমরান খান লেডি কিলার বা প্লেবয় হিসেবে পরিচিত ছিলেন কিন্তু তিনি তার রাজনীতির জন্য ‘রিয়াসাত-ই-মদিনা’ স্লোগান বেছে নিয়েছেন। তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ স্লোগান প্রবর্তনও করেছিলেন। কিন্তু তিনি নওয়াজ শরিফ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সামরিক বাহিনীর কাঁধে চড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
ইমরান যখন ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হারান তখন তিনি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। কয়েক মাস পর, তিনি মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সহানুভূতি অর্জনের জন্য কিছু লবিস্ট নিয়োগ করেন। তার সমালোচকরা তাকে ‘ইউ-টার্ন খান’ এবং ‘একজন ভন্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন কিন্তু নিজের সমস্ত বৈপরীত্য সত্ত্বেও, ইমরান খান এখনও পাকিস্তানিদের একটি বড় সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে একজন নায়ক।
নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে তিনটি ভিন্ন আদালত ইমরান খানকে পাল্টাপাল্টি রায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তার বিরোধীরা দাবি করছে, সাইফার মামলার রায় তাকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রমাণ করেছে কারণ তিনি জনসাধারণের কাছে কিছু গোপনীয়তা ফাঁস করেছিলেন। অন্যদিকে তোষাখানা মামলার রায়ে তাকে দুর্নীতিবাজ ঘোষণা করা হয় এবং বেআইনি বিয়ে মামলার রায় তার অনৈতিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
নওয়াজ শরিফ এবং বিলাওয়াল ভুট্টোসহ তার বিরোধীরা ইমরানের বিরুদ্ধে এই রায়গুলো থেকে সর্বাধিক রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন; তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সাজা ঘোষণা করে আদালতের দেওয়া এসব রায় ইমরান খানের প্রতি মানুষের সহানুভূতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আদালত সাধারণ পাকিস্তানিদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে ধোঁকা দিতে পারে না।
পাকিস্তানের সকল স্তরের জনসাধারণ বুশরার সাবেক স্বামী ডা. খাওয়ার মানেকার ২০১৮ সালে দেওয়া ভিডিও বিবৃতিটি মনে রেখেছে। সেখানে তিনি শপথ করে বলেছিলেন, ইমরান খান তার বিয়ে ভাঙেননি এবং বুশরা বিবি বিশ্বের সবচেয়ে ধার্মিক নারী। একই মানেকা ২০২৪ সালে তার সাবেক এই স্ত্রী সম্পর্কে তার বক্তব্য পরিবর্তন করেছেন। তবে অনেক লোক তার নতুন এই অবস্থানকে গত বছর তার গ্রেপ্তারের সাথে যুক্ত করে দেখছে এবং মানুষ তাকে এখন বিশ্বাস করে না। এমনকি ইমরান খানের পুরোনো সমালোচকদের কেউ কেউ তার বিয়ের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের নিন্দা করতে বাধ্য হয়েছেন।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের (এইচআরসিপি) উদাহরণ দেখা যাক। ইমরান এইচআরসিপিকে বহুবার অভিযুক্ত করেছেন, শুধুমাত্র সামরিক সংস্থাকে খুশি করার জন্য এই সংস্থা বিদেশি এজেন্ডা প্রচার করেছে। তবে এইচআরসিপি ইমরানের বেআইনি বিবাহের মামলার রায় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি বলছে: ‘এই রায়ে মানুষের গোপনীয়তার অধিকার, বিশেষ করে আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন নারীদের মর্যাদার অধিকার এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বিবাহবিচ্ছেদ এবং বিবাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে সমস্যাজনক প্রভাব রয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পাকিস্তান পেনাল কোডের ৪৯৬ ধারা নজিরও স্থাপন করতে পারে।’
ইমরান খানের সমর্থনে এইচআরসিপির এই বিবৃতি আদালতের রায়ের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করার চেষ্টাকারীদের জন্য বড় পরাজয়। অন্যদিকে এইচআরসিপির এই বিবৃতিটি ইমরানের বর্ণনার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। ইমরান সর্বদা তার সমালোচকদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ঘোষণা করে এসেছেন এবং শত্রুদের এজেন্ডা প্রচারের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেও অভিযুক্ত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ইমরান খান দাবি করেছিলেন, পাকিস্তানের মিডিয়া ব্রিটেনের চেয়েও স্বাধীন। যদিও ২০২১ সালে প্যারিস-ভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ইমরান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণকারী হিসাবে ঘোষণা করেছিল।
যদিও ইমরান খানের সরকার সেসময় আরএসএফের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। তবে ইমরান খান অস্বীকার করতে পারেন না যে, তিনি পাকিস্তানি মিডিয়ায় নওয়াজ শরিফের কভারেজ নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির একটি সাক্ষাৎকার তার নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছিল কারণ জারদারির সেসময় বিচার চলছিল।
এরপর যখন ২০২৩ সালে পাকিস্তানের মিডিয়া থেকে ইমরান খানের ছবি, খবর ও সাক্ষাৎকার উধাও হয়ে যায় এবং ইমরানকে পাকিস্তানি মিডিয়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়, তখন একই আরএসএফ পাকিস্তানে অঘোষিত সেই সেন্সরশিপের নিন্দা করেছিল। আর এখন ইমরান খান বিচারাধীন নয়, আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত। আমার মতো অনেক সাংবাদিকেরই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়- কেন আমরা ইমরান খানের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া রায়ের সমালোচনা করছি। যদিও ইমরান ক্ষমতায় থাকাকালীন আমি নয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলাম। ইমরান খানের সঙ্গে আমার কোনও ব্যক্তিগত সমস্যাও ছিল না।
আমি ২০১৮ সালে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ বশিরের রায়ের সমালোচনা করেছিলাম এবং পিটিআইয়ের সোশ্যাল মিডিয়া আমাকে পাকিস্তানবিরোধী বলে ঘোষণা করেছিল। এখন আমি ইমরান খানের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ বশিরের রায়ের সমালোচনা করছি এবং পিএমএল-এন মিডিয়া ম্যানেজাররা আমার ওপর ক্ষুব্ধ। আমি মনে করি, ইমরানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক এই রায় জাতিকে আরও বিভক্ত করবে। তার বিরোধীরা এই রায়গুলো থেকে উপকৃত হতে পারে কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যা করবেন, তেমনই ফল পাবেন। ইমরান তার সমর্থকদের হৃদয় ও মনে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণার বীজ বপন করেছিলেন এবং আজ তিনি তার ফল পাচ্ছেন।
আমি ইমরান খানকে ১৯৮৭ সাল থেকে চিনি। সেসময় তিনি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেসময় একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে, আমি লাহোরে কিছু ছাত্রের সমাবেশ কভার করেছি যারা ইমরানকে তার অবসরের সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি করেছিল। অবশেষে, ইমরান তার অবসরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং আমি ১৯৮৮ সালে ডেইলি জং-এর জন্য প্রথমবার তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম।
জেনারেল জিয়া-উল-হক ১৯৮৮ সালে মুহাম্মদ খান জুনেজোর সরকারকে বরখাস্ত করেন এবং এরপর নতুন সরকারে মন্ত্রী হওয়ার জন্য ইমরানের কাছে যান তিনি। ইমরান একবার আমাকে বলেছিলেন, জেনারেল জিয়ার ছোট ছেলে ডক্টর আনোয়ার উল হক তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এবং তাকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিতে তার বাবার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। তবে ইমরান বিনয়ের সাথে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু এর পরে আরও অনেক লোক তাকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করতে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছিল।
ক্রিকেটার হিসেবে অনেক রেকর্ড গড়েছেন ইমরান খান। তিনি ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের হয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছেন। এরপর ১৯৯৩ সালে মঈন কোরেশির তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যোগদানের জন্য সামরিক সংস্থা আবারও তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। এইবার ইমরান খান সরকারে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কারণ ১৯৯২ সালে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। একদিন তাকে লাহোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে (এলসিসিআই) আমন্ত্রণ জানানো হয়। এলসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন ইসহাক দার। তিনি শওকত খানম হাসপাতালে ২০ লাখ রুপি দান করেন। ইসহাক দারের অফিসে চায়ের সেই দাওয়াতে গিয়ে প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর সমালোচনা করেন ইমরান খান। আমি দৈনিক জং-এর জন্য বেনজির সম্পর্কে ইমরানের মন্তব্য ছেপেছিলাম।
কিন্তু পরের দিন ইমরান খানকে আমার সংবাদের বিরোধিতা করতে বলা হয়। দ্বিমত পোষণ করে একটি লেখা প্রকাশ করার জন্য ইমরান আমার কাছে আসেন। আমি প্রত্যাখ্যান করলে, আমাকে বলা হয়- আমার সংবাদ তাকে বিতর্কিত করে দিয়েছে এবং মঈন কুরেশি তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেছেন। আমার সংবাদের বিরোধিতা করার জন্য তিনি ইসহাক দারের সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু দারও সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ইমরান খান আরেক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে দ্বন্দ্ব জারি রাখলেও পরে তাকে আর তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু পরে, আমরা এই সমস্যাটি সমাধান করি, কারণ ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করতে আমি তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।
১৯৯৬ সালে লাহোরে হওয়া একটি বৈঠকের কথা আমার মনে আছে, যেখানে প্রয়াত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল ইমরানকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি তখন আইএসআইয়ের সাবেক এই ডিজির সাথে দ্বিমত পোষণ করি এবং ইমরান খানকে বলেছিলাম, তিনি একজন অবিসংবাদিত জাতীয় বীর যিনি ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করছেন এবং তার রাজনীতি তার হাসপাতালের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। সেই বৈঠকে ইমরান আমার সাথে একমত হলেও কয়েকদিন পর তিনি তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠা করেন।
আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম, ইমরান খান রাজনীতির জন্য উপযুক্ত নয় কিন্তু তিনি আমাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি পাকিস্তান থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তিনি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সঙ্গেই আলিঙ্গন করেন। বেশিরভাগ রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কিন্তু তার অনুগত ভোটারদের একটি বড় অংশ তাকে কখনোই ত্যাগ করেনি।
এখন ইমরান কারাগারে থাকলেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়ছেন তিনি। দুই বছরেরও কম সময়ে ফৌজদারি মামলার ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। তাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু শেষ হয়ে যাননি। তিনি নির্বাচনী দৌড়ের বাইরে থাকলেও এখনও তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। অনেক বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, তিনি স্বভাবগতভাবেই জনপ্রিয়।
তিনি কখনোই পাকিস্তানের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারেননি। তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ করার প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ করেননি। কিন্তু তার বিরোধীদের দুর্বলতাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। যখন তিনি সামরিক সংস্থার সাথে কিছু সমস্যা তৈরি করেন ঠিক তখনই নওয়াজ শরিফ তার সামরিক বাহিনীবিরোধী অবস্থান পরিবর্তন করেন।
ইমরান খান তৎক্ষণাৎ সামরিক নেতৃত্বের দিকে বন্দুক তাক করেন। আমি মনে করি, উভয় পক্ষ একে অপরকে অবমূল্যায়ন করেছে। সামরিক নেতৃত্ব কখনও ভাবেনি, পিটিআই গত বছরের ৯ মে সামরিক স্থাপনায় হামলা চালাবে। অন্যদিকে পিটিআই কখনোই আশা করেনি, ইমরান খান এতো দ্রুত বেআইনি বিয়ের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবেন।
ইমরানকে ২০১৮ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসিয়েছিলেন। বাজওয়া যখন জানতে পারেন, ইমরান বুশরা বিবিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তিনি তাকে থামানোর চেষ্টা করেন।
এক বার্তায় তিনি ইমরানকে জানান, বাজওয়া তাকে এই বিয়ে না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইমরান বুশরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তারপর বাজওয়াকে ইমরান বলেছিলেন, তিনি ইতোমধ্যেই এটি করেছেন। মূলত বাজওয়া প্রধানমন্ত্রীর অফিসে একজন ইয়েস ম্যান চেয়েছিলেন। তার নিজের কিছু এজেন্ডা ছিল। বলা হয়ে থাকে, ইমরান তার আনুগত্য করার চেয়ে বেশি বার তার অবাধ্য হয়েছেন।
সাইফার মামলার রায়ে ইমরানকে রাষ্ট্রবিরোধী ঘোষণা করেছে। কিন্তু তিনি কাশ্মির এবং ইসরায়েল সম্পর্কিত অনেক গোপনীয়তা প্রকাশ করেননি। কারণ তার সমস্যা জেনারেল বাজওয়ার সাথে ছিল, জেনারেল ফয়েজের সাথে নয়। আর জেনারেল ফয়েজ পাকিস্তানের বাইরে পর্দার আড়ালে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ নানা মিটিংয়ের অংশ ছিলেন। ইমরান যদি রাষ্ট্রবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ হয়েই থাকেন, তাহলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসানোর জন্য দায়ী কে?
ইমরান খান জেলে আছেন, ভোটে ও সরকারি পদে অযোগ্য এবং আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেও তিনি রাজনীতির বাইরে নন। দোষী সাব্যস্ত ও অযোগ্যতার পরও নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় ফিরতে পারলে ইমরান খান কেন নয়? নওয়াজ শরিফ উচ্চ আদালত থেকে মুক্তি পেতে পারলে ইমরান খান কেন পাবেন না?
উভয়কেই তাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পাকিস্তানে আইনের মাধ্যমে শাসন নয়, আইনের শাসন দরকার। তার সমর্থকরা নির্বাচনের দিন পিটিআই প্রার্থীদের সমর্থনে ভোট দিয়ে ইমরানকে সাহায্য করার চেষ্টা করবেন। পিটিআই এই নির্বাচনে জিততে নাও পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, পার্লামেন্টে অল্প সংখ্যক আসন পেলেও ইমরান কোথাও হারিয়ে যাবেন না।
• হামিদ মীর পাকিস্তানের একজন সিনিয়র সাংবাদিক, উপস্থাপক এবং কলামিস্ট। তিনি জিও নিউজের সাথে যুক্ত আছেন। জিও নিউজে প্রকাশিত এই নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন তারেক মাহমুদ।
টিএম