ফিলিস্তিন জিতবে, আশা লঙ্কানদের
বেশিরভাগ দিনই শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর ডলসি ফালাস্তিন রেস্তোরাঁটি শান্ত থাকে। ব্যস্ত শহরের পাশের একটি প্রধান সড়কে অবস্থিত এই ভোজনশালা বেশ কোলাহল মুক্ত। ঐতিহ্যবাহী আরবি লণ্ঠনের আলোর উষ্ণ আভায় এখানে খাবার উপভোগ করা যায়।
গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল তার নির্মম আক্রমণ শুরু করার সাত সপ্তাহ পর এক রোববারে ফিলিস্তিনি বিশেষ খাবারের এই রেস্তোরাঁটি তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তাদের সবার একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্য একটাই : ফিলিস্তিনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা।
আয়েশা আলতাফ নামের ২৪ বছর বয়সী এক তরুণী উদ্যোক্তা প্রসাধনী ব্যবসা পরিচালনা করেন। এই তহবিল সংগ্রহের পেছনে রয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ল্যুর ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তহবিল সংগ্রহে স্টল স্থাপন এবং তাদের উপার্জনের কমপক্ষে ১০ শতাংশ গাজায় দান করার ব্যবস্থা করেছে সংস্থাটি। তবে সেখানকার বেশিরভাগ বিক্রেতাই তাদের আয়ের পুরো অর্থই ফিলিস্তিনিদের জন্য দান করেছেন।
কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে আলতাফ বলেছেন, ‘‘গাজার মানুষের সাথে যা ঘটছে ক্রমাগত তার ছবি এবং ভিডিওগুলো দেখার পর আমি বিছানায় ঘুমানো, পানি পান এবং গরম খাবারের মতো মৌলিক জিনিসপত্র ব্যবহার করতে গিয়ে অপরিসীম অপরাধবোধে ভুগছি।’’
‘‘এটা অবশ্যই গণহত্যা। এবং যারা এটা দেখতে পাচ্ছে না, তারা কেবল পুরো ঘটনাকে উপেক্ষা করার পথ বেছে নিচ্ছে।’’
• আমরা অসহায় বোধ করছি
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মানবিক দাতব্য সংস্থা আফ্রিকা মুসলিম এজেন্সির সহযোগী হিসেবে কাজ করছে ল্যুর ফাউন্ডেশন। আফ্রিকা মুসলিম এজেন্সি গাজায় সহায়তা সরবরাহের কাজে ল্যুর ফাউন্ডেশনের তোলা অর্থ ব্যবহার করবে। শ্রীলঙ্কার এই সংস্থাটি এখন পর্যন্ত অনুদান ও তহবিল হিসেবে ২১ লাখেরও বেশি শ্রীলঙ্কান রুপি (৬ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার) সংগ্রহ করেছে।
আয়েশা আলতাফ বলেন, ‘‘আমরা গাজায় অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গরম খাবার সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছি। শীত ঘনিয়ে আসায় আমরা শিশুদের জন্য শীতের জ্যাকেটও দিচ্ছি— বিশেষ করে যারা বাস্তুচ্যুত এবং রাস্তায় ঘুমাচ্ছে তাদের জন্য।’’
তহবিল ও অনুদান সংগ্রহের অনুষ্ঠানে লাল এবং সবুজ ডোরাকাটা কালো পোশাক পরিহিত ১৪ বছর বয়সী মুমিনা হিলমি তার মায়ের সহায়তায় নিজের স্টল চালাচ্ছে। সে ফিলিস্তিনি পতাকার রঙ দিয়ে তৈরি ব্রেসলেট এবং চাবির রিং বিক্রি করছে।
মুমিনা হিলমি আলজাজিরাকে বলেছে, ‘‘আমি স্কুলে আমার অবসর সময়ে এগুলো তৈরি করেছি।’’
মিকেলা ফার্নান্দো (২৫) একটি ব্রেসলেট কিনেছিলেন। তিনি বলেন, একটি বড় স্বার্থের প্রতি সহায়তা করতে পেরে তিনি খুশি। মুমিনা বলেন, ‘‘অনেক বড় বড় সংস্থা এবং অনেক দেশের সরকার গাজায় যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করা ছাড়া অন্য কোনো সহায়তা করেনি। আমরা অসহায় বোধ করছি। এখানে এসে আমার মনে হয়েছে, আমি কিছুটা সহায়তা করতে পারি।’’
উদ্যোক্তা এবং দর্শনার্থী, তহবিল সংগ্রহকারীরা— প্রসাধনী, খাবার, সুগন্ধি, খেলনা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা-বেচা করছেন। আর এখানকার সব পণ্যই ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতির প্রতীকের আদলে তৈরি করা হয়েছে।
২৬ বছর বয়সী রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী সাজিদা শাবির তার নিজস্ব ব্র্যান্ড হাংরিসল্যান্ডারস রেস্তোরাঁয় বাড়িতে তৈরি চিকেন রোল, বিস্কুট, মরিচের গুঁড়া এবং মেয়োনিজের মতো খাবার ও খাদ্যপণ্য বিক্রি করছেন। তাকে সহায়তা করার জন্য তার মা এবং বোন সেখানে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘‘আমি আগে অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করেছি। কিন্তু কেবল অর্থ দান করার পরিবর্তে আমি এখানে খাদ্যপণ্য বিক্রির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সহায়তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর এতে আমার ভালো লাগছে।’’
• গাজা সংঘাতে শ্রীলঙ্কার অবস্থান
ব্রিটিশ শাসনে থাকাকালীন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি স্যার আলেকজান্ডার জনস্টন দ্বীপটিতে একটি ইহুদি বসতি স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলেন; যা সেই সময় সিলন নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু তার এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। ২০২১ সালে ইসরায়েলি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান বেগিন-সাদাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই তথ্য পাওয়া যায়।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে শ্রীলঙ্কা। তখন থেকে দেশটি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন সংকটে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
প্রায় তিন দশক ধরে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলঙ্কা দেশটির বিদ্রোহীগোষ্ঠী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলামের (এলটিটিই) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই বিদ্রোহীগোষ্ঠী দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে তামিলদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক উদিথা দেবপ্রিয়া বলেছেন, সিংহলী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো— যারা বিশ্বাস করে যে শ্রীলঙ্কা কেবল বৌদ্ধদের জন্য নির্বাচিত ভূমি, ইহুদিদের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমি হিসেবে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বিষয়ে এই গোষ্ঠীগুলো প্রায় একই ধরনের সহানুভূতিশীল ধারণা পোষণ করে। কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলোই আবার শ্রীলঙ্কায় কথিত যুদ্ধাপরাধের তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বানের বিরোধিতা করেছে। তারা পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈত নীতি দেখে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার পক্ষে সাফাই গায়।
কলম্বো-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টামের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান বিশ্লেষক দেবপ্রিয়া আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘‘এখন সিংহলী জাতীয়তাবাদীরা গাজা উপত্যকার ট্র্যাজেডিকে পশ্চিমা বিশ্বের ভণ্ডামি হিসেবে দেখছেন।’’
গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো ইসরায়েলকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছে। তারা শ্রীলঙ্কার যুদ্ধের সময় সংঘটিত কথিত যুদ্ধাপরাধের তদন্তের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দ্বৈত নীতির অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের জন্য যা প্রযোজ্য তা অবশ্যই গাজাতেও হতে হবে।’’
• ফিলিস্তিনের সমর্থনে সংহতি সমাবেশ
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এই হামলার বিরোধিতায় শ্রীলঙ্কায় ইতোমধ্যে কয়েক ডজন বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বিক্ষোভে হাজার হাজার লঙ্কান নাগরিক অংশ নেন। শ্রীলঙ্কাজুড়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে লোকজনকে ‘‘গণহত্যা বন্ধ কর’’ এবং ‘‘ইসরায়েলি বর্ণবাদ বন্ধ কর’’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করতে দেখা যায়।
দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় গাজা উপত্যকায় ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে। আর গাজার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন এক হাজার ২০০ জনের বেশি। কাতার, মিসর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হামাস ইসরায়েলের মাঝে তিন দফায় সাত দিনের যুদ্ধবিরতির শেষ দিন চলছে বৃহস্পতিবার। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের কারাগার থেকে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি ও হামাসের হাত থেকে কয়েক জন জিম্মি মুক্তি পেয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় শহর জাফনা একসময় গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তামিল জাতীয়তাবাদীদের একটি গোষ্ঠীও গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাফনায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম এবং হিন্দু ধর্মের নেতারা কলম্বোতে ফিলিস্তিনের সমর্থনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার সময় ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চের ফিলিস্তিনে পাঠানো একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের অংশ ছিলেন শ্রীলঙ্কার ফাদার লিওনেল পেরিস। তিনিও ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে জাফনায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। ফাদার লিওনেল পেরিস বলেন, ‘‘যখন মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তাদের জমি ও ঘরবাড়ি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তখন মানুষ হিসেবে এগুলো দেখুন। তাদের কষ্ট অনুভব করুন। তাদের দুঃখ এবং ক্ষোভ অনুভব করুন। আপনি এটা কোনোভাবেই ঘটতে দিতে পারেন না।’’
‘‘বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সম্পূর্ণ অমানবিক আচরণ করেছে। এটা এভাবে চলতে পারে না।’’
শ্রীলঙ্কার শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শক ট্যাসি ডাহলান কলম্বোতে মার্কিন দূতাবাস এবং জাতিসংঘ ভবনের সামনে ফিলিস্তিনের সমর্থনে অনুষ্ঠিত কমপক্ষে পাঁচটি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘সেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি শিশুরা নিহত হয়েছে। কিছু দেশের রাজনৈতিক এজেন্ডার কারণে তাদের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আর এসব দেশের নেতারা মানবতার প্রতি অন্ধ।’’
কলম্বোতে ফিলিস্তিন দূতাবাসের একটি স্মৃতিসৌধে লোকজন ফুল দিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, ফিতা বেঁধে সংহতি সমাবেশ করেছেন। লঙ্কান নাগরিক অধিকার কর্মী মেলানি গুনাথিলাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গাজা-ইসরায়েল সংঘাতের ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
গুনাথিলাকা বলেন, ‘‘অর্থ এবং ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মতো করে গাজা-ইসরায়েল সংঘাতের আখ্যান তুলে ধরছেন। এ কারণেই আমি যাচাইকৃত তথ্য শেয়ার করার চেষ্টা করি।’’
তহবিল সংগ্রহ শেষে ডলসি ফালাস্তিন রেস্তোরাঁয় ফিরে আয়েশা আলতাফ জানালেন, তিনি এখন ‘‘একটু কম অসহায়’’ বোধ করছেন। আশাপ্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘‘আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ, সহযোগিতাপ্রবণ এবং সহানুভূতিশীল হই। আমাদের সবার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার শক্তি রয়েছে। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রবল প্রভাব রয়েছে, যা আমাদের নিজস্ব সীমানা ছাড়িয়ে জীবনকে প্রভাবিত করে।’’
এসএস