হামাস নিয়ে কৌশলী ভারত
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায়। তারা এর নাম দেয় ‘অপারেশন আল-আকসা স্টর্ম।’ পশ্চিমা দেশগুলো হামাসের এ হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে টুইট করেছেন। তিনি একে সন্ত্রাসী হামলা বলেও অভিহিত করেছেন। তবে মোদির টুইটে কোথাও হামাসের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেনি। এই হামলার আগেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করত।
ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন বুধবার মোদি সরকারের কাছে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
হামাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে মতামত বিভক্ত। আরবের ইসলামী দেশগুলো হামাস সম্পর্কে এক রকম ভাবে চিন্তা করে এবং পশ্চিমা দেশগুলো ভিন্নভাবে চিন্তা করে। এমনকি এশিয়াতেও হামাস সম্পর্কে কোনো অভিন্ন চিন্তাভাবনা নেই।
বুধবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, হামাস কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, তারা তাদের ভূমি ও জনগণের জন্য, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।
কী বললেন ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত?
ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ভারত বিশ্বজুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘কণ্ঠস্বর।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রথম বিশ্ব নেতাদের মধ্যে একজন যিনি এই সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করেছিলেন। তিনি এর গুরুত্ব বোঝেন। তাই সময় এসেছে ভারতের হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার।
ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত বলেন, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এই প্রথম নয় যে আমরা এই বিষয়ে কথা বলেছি। আমরা সন্ত্রাসী হুমকির সমস্যা বুঝতে পারি... আমরা (ভারতের ওপর) চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু জিজ্ঞেস করছি।
ভারতের জবাব
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একে সন্ত্রাসী হামলা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেনি।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতের এই আবেদনের পর সংবাদ ওয়েবসাইট ‘দ্য প্রিন্ট’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচির সঙ্গে যোগাযোগ করে।
দ্য প্রিন্টের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অরিন্দম বাগচি বলেন, কোনও সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা ‘আইনি বিষয়।’
তিনি বলেন, ভারতীয় আইন অনুযায়ী কাউকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা আইনি বিষয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিচ্ছি। আমি মনে করি আমরা খুব স্পষ্ট যে আমরা এটিকে একটি সন্ত্রাসী হামলা হিসাবে দেখছি। কিন্তু সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রশ্নে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্টরাই জবাব দেওয়ার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
এর আগে গত ১২ অক্টোবর এক সাংবাদিক বাগচিকে প্রশ্ন করেছিলেন, হামাসকে কি ভারত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ঘোষণা করেছে? তখনও বাগচি এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব দেননি। তিনি বলেছিলেন যে, এই জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়। আমাদের লক্ষ্য আমাদের নাগরিকদের সাহায্য করা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডার মতো পশ্চিমা দেশগুলো হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু ভারত হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেনি।
জামিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স-এর সিনিয়র ফেলো ড. সুজাতা ঐশ্বরিয়া বলছেন, অতীতে এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীরাও এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে হামাস ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এর তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, হামাস বা হিজবুল্লাহ কখনোই সরাসরি ভারতের ক্ষতি করেনি। ভারতের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনাকারী অন্যান্য সংগঠনের বিরুদ্ধে ভারত জাতিসংঘে আওয়াজ তুলেছিল এবং তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করার আবেদন করেছিল।
হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সমস্ত বিদেশি শক্তি তখন তাকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। হামাস রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অংশ।
কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট ছিল। তারা হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে। একই সঙ্গে গাজার ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে ইসরায়েল। কিন্তু এটা সত্য যে ফিলিস্তিনিরা হামাসকে বেছে নিয়েছে।
আরও পড়ুন
গাজায় ভারতীয় কনস্যুলেটও ২০০৬ সালের প্রথম গাজা জেরিকো পরিকল্পনার অধীনে কাজ করছিল। তাই ভারত হামাসকে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের অংশ হিসেবে দেখছে। তবে হামাসের সঙ্গে ভারতের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।
সুজাতা বলছেন যে এটি না করার জন্য একটি নৈতিক কারণ থাকতে পারে। ভারত নিজেই তার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এমন কিছু শক্তি ছিল যারা সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিল।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য যাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তা সাধারণত সব জাতীয় আন্দোলনে চরমপন্থী শক্তি। এমনকি ইহুদি আন্দোলনে ১৯৪০-এর দশকে সহিংস শক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, স্টর্গ গ্যাং এবং ইরগুন সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল। সুতরাং ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিক চাপও এর কারণ হতে পারে।
এর পেছনে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মনোভাবকেও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখছেন মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ড. ফাজ্জুর রহমান।
তিনি বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সবসময়ই নিরপেক্ষ। আমরা সবসময় মধ্যম পথ বেছে নিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যের মতো আমরা আগ্রাসী নই। ভারত কখনই অন্য কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে না এবং ফিলিস্তিনের সাথে তার সম্পর্ক ইসরায়েলের চেয়ে পুরোনো। অতএব, একটি পুরোনো অংশীদার হিসাবে, ভারত কেবল ফিলিস্তিন নয়, অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও সম্মান করে এবং এতে হস্তক্ষেপ করে না।
সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণার পদ্ধতি কী?
সুজাতা ঐশ্বরিয়া বলছেন, এটি করার দুটি উপায় থাকতে পারে। অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে, আপনি সমস্ত তথ্য এবং কারণ তুলে ধরে একটি নীতি তৈরি করে একটি নির্দিষ্ট সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করতে পারেন।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যদি কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে হয়, তাহলে জাতিসংঘ তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কোনো সংগঠন সন্ত্রাসী কি না। বাকি সদস্য দেশগুলো এ বিষয়ে তাদের মতামত দিতে পারে, ভেটো দিতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে এবং আমি যতদূর জানি, কোনো দেশেরই এ ধরনের কোনো নিয়ম বা মানদণ্ড নেই। যাতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনো নির্দিষ্ট সংগঠন সন্ত্রাসী কি না।
একটি নির্দিষ্ট সংগঠন একটি নির্দিষ্ট দেশের জন্য সন্ত্রাসী হতে পারে আবার একটি নির্দিষ্ট দেশের জন্য নাও হতে পারে। এর জন্য কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই।
এ অবস্থায় যেসব দেশে এসব সংগঠন কাজ করে বা কোনো ক্ষতি করে, সেসব দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল এখন ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রশংসা করলেও একই সংগঠনকে তারা প্রথম দিকে ফিলিস্তিনি জাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করত।
আরও পড়ুন
মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো হামাসকে খুব ভালোভাবে না দেখলেও কাতারের সঙ্গে হামাসের সুসম্পর্ক রয়েছে। কাতারে হামাসের একটি ব্যুরো অফিসও রয়েছে।
একটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী ঘোষণার পর কী হবে?
ফজ্জুর রহমান বলেন, প্রথমেই তাদের অর্থের উৎস যাচাই করতে হবে। এরপর অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সেই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ আছে তা ও সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করা হয়।
কোন কোন দেশ সংগঠনের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সমর্থন করছে আর কোনটা দেশদ্রোহী, সেটাও দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, খালিস্তান সমর্থক, যাদের বিরুদ্ধে ভারত মামলা দায়ের করেছে তাদের অনেকে ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে কানাডায় বসবাস করছেন। এই দেশগুলো তাদের জায়গা দিয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তাদের কোনো না কোনোভাবে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
হামাস কী?
হামাস ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী একটি সসস্ত্র গোষ্ঠী। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার (পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের উপস্থিতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) পর এই গোষ্ঠীটি অস্তিত্ব লাভ করে।
গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসলো প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে।
সংগঠনটির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ফিলিস্তিনে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
হামাস রাজনীতিতে সক্রিয় এবং নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।
সংগঠনটির একটি রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। এর দুটি প্রধান ফাংশন রয়েছে -
- পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ। সামাজিক ও ধর্মীয় উপায়ে সম্প্রদায়কে সহায়তা করা। ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং দশম ফিলিস্তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
হামাসের সামরিক শাখা কাসিম ব্রিগেড ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে অনেক রক্তক্ষয়ী হামলা চালিয়েছে। মোহাম্মদ দীন বর্তমানে এই ব্রিগেডের প্রধান।
২০০৬ সালে হামাস অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নির্বাচনে জয়লাভ করে।
হামাস ২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করছে। এখানকার সব গুলো বিভাগ হামাস দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গণমাধ্যমে মুখ ঢেকে রাখতে দেখা গেছে।
২০১৭ সালে হামাস পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে সম্মত হয়।
এনএফ