হামাসের হামলায় বিপর্যস্ত ইসরায়েল, এখন কী ঘটবে?
ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ইসরায়েলের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছিল মিসর ও সিরিয়া। যা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়। এবারে একই উপায়ে ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করেছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস।
এবারও ইহুদিদের ছুটির সময়ে এই অপ্রত্যাশিত হামলার ঘটনা ঘটে।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজা উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়ছিল। তবে গাজার শাসক দল হামাস অথবা ইসরায়েল কেউই সেই উত্তেজনা আর বাড়াতে চায়নি।
কিন্তু নিরবে হামাস একটি গোছানো আর সমন্বিত অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছিল।
গতকাল শনিবার (৭ অক্টোবর) সকালে তারা জেরুজালেম এবং তেল আবিব পর্যন্ত একের পর এক রকেট নিক্ষেপ শুরু করে। সেই সাথে ফিলিস্তিনি ওই যোদ্ধারা সমুদ্র, স্থল এবং আকাশপথে দক্ষিণ ইসরায়েলে প্রবেশ করে।
তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইসরায়েলি শহর ও সেনা ঘাঁটিগুলো ঘেরাও করে আক্রমণ করে এবং বহু মানুষকে হত্যা করে।
সেইসাথে তারা অজ্ঞাত সংখ্যক ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যদের গাজায় জিম্মি করে রাখার জন্য আটক করে নিয়ে যায়।
হামাসের সমন্বিত এ হামলায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন অনেক ইসরায়েলি। তারা বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন। সঙ্গে সেনাবাহিনীর ধীর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
এখন কী হবে?
হামাসের এ আকস্মিক হামলায় খুশি হয়েছেন গাজাবাসী ও ফিলিস্তিনিরা। তবে সঙ্গে তাদের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে। তারা আশঙ্কা করছেন, প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে।
গাজার এক বাসিন্দা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘আল-আকসায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিশোধ নিতে হামাস এখন পর্যন্ত যা যা করেছে তাতে আমি খুশি।’
সঙ্গে নিজেদের শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন এই যুবক। তিনি বলেছেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন, ২০২১ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার কারণে শোরুক টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতে আমার পরিবার একটি দোকান হারায়, এবার হামাস অনেক বড় আকারে হামলা চালিয়েছে, তাই ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আরও বড় হবে।’
শনিবারের হামলার পরই গাজায় শক্তিশালী বিমান হামলা চালানো শুরু করে ইসরায়েল। আর তাদের এ হামলায় ইতিমধ্যে প্রায় ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত ও নিহতদের মরদেহে সয়লাব হয়ে গেছে সেখানকার হাসপাতালগুলো।
২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজায় অবরোধ আরোপ করে রাখায় সেখানকার প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষকে প্রতিদিন দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। নতুন এ সংঘাত এখন তাদের এই সমস্যা আরও প্রকট করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সবশেষ ২০২১ সালে ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত হয়। এরপর মিসর, কাতার এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে গাজার বাসিন্দাদের ইসরায়েলে কাজ করার জন্য হাজার হাজার কাজের অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হয়।
সেইসাথে পরিস্থিতি শান্ত রাখার বিনিময়ে অন্যান্য বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছিল।
গত মাসে, যখন শত শত ফিলিস্তিনি পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া গণ-বিক্ষোভের স্মরণে কাঁটাতারের বেষ্টনীর পাশে বিক্ষোভে যোগ দিতে শুরু করে, তখন ধারণা করা হয়েছিল যে এটি হামাসের প্ররোচনায় হয়েছে।
এর উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও সুবিধা আদায় করা এবং কাতারের থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া।
ছোট ছোট সমাবেশগুলোকেও এখন ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। অনেকে সন্দেহ করছেন আক্রমণ শুরুর আগে ইসরায়েলের সুরক্ষা বেষ্টনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যই ওই সমাবেশ হয়েছে।
এই সর্বশেষ অভিযানের মাধ্যমে, হামাস আবারও একটি সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদেরকে নতুনভাবে জাহির করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। যারা ইসরায়েলের ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আক্রমণের শুরুতে হামাসের কমান্ডার, মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবদের "ইসরায়েলি দখলদারিত্ব দূর করার" অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এখন একটি বড় প্রশ্ন হল, অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম বা এই অঞ্চলের অন্য জায়গায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা তার আহ্বানে সাড়া দেবে কিনা।
ইসরায়েল নিঃসন্দেহে একাধিক ফ্রন্ট থেকে যুদ্ধের আশঙ্কা করছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি যা হতে পারে তা হল, এটি শক্তিশালী লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
এদিকে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। গাজায় তীব্র বিমান হামলার পাশাপাশি তারা সেখানে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এই ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী যেসব ইসরায়েলি সৈন্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের আটক করেছে তাদেরকে তারা, মানব ঢাল বা দর কষাকষির অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী- আইডিএফ এর মুখপাত্র রিয়ার এডিএম ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত। আমরা ব্যাপকভাবে হামলা চালাচ্ছি, বিশেষ করে গাজা উপত্যকার আশেপাশের এলাকার নজরে রাখছি। আমরা খুব তীক্ষ্ণ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করব।’
এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা সম্পন্ন না হলেও, এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নিজেরাই যাচাই করতে শুরু করেছে যে কীভাবে তারা এই হামলার বিষয়ে আগে থেকে জানতে পারেনি এবং কেন তারা এই বিশাল হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা