ইসরায়েলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাদের যেভাবে ফাঁকি দিল হামাস
‘এটা কীভাবে ঘটল, সে ব্যাপারে আমাদের কোনও ধারণা নেই।’ ইসরায়েলের গোয়েন্দারা তাদের বিশাল শক্তি আর নজরদারি সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও কীভাবে হামাসের হামলার বিষয়টি টেরই পেল না, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের কাছে এই হামলার বিষয়ে আগাম কোনও তথ্যই ছিল না বলে জানিয়েছেন।
শনিবার ভোরের দিকে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হাজার হাজার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি ব্যাপক নিরাপত্তাবেষ্টিত সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েছে। হামাসের সাথে ইসরায়েলের হামলা-পাল্টা হামলায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে অন্তত ১০০ জন এবং গাজা উপত্যকায় ১৯৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
স্মরণকালের ভয়াবহ হামাসের হামলায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা তৎপরতায় নিয়োজিত মোসাদ এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব ধরনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে ফাঁকি দিয়ে ইসরায়েলে ভয়াবহ ওই হামলা চালিয়েছে হামাস। কিন্তু এই হামলা যে হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কারও কাছেই কোনও তথ্য ছিল না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বিবিসির নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক গার্ডনার এই বিষয়ে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। এতে তিনি হামাসের হামলার বিষয়ে ইসরায়েলে গোয়েন্দা সংস্থা সিন বেত এবং মোসাদের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। গার্ডনার লিখেছেন, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা হামাসের হামলা যে আসন্ন, সেটি যদি জেনেও থাকেন তাহলে তারা তা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বিস্তৃত এবং অত্যন্ত ভালো অর্থায়নের গোয়েন্দা পরিষেবা রয়েছে। যা বলা যায় একেবারে তর্কাতীত। ফিলিস্তিন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি লেবানন, সিরিয়া এবং অন্যান্য জায়গায়ও তাদের তথ্যদাতা এবং এজেন্ট রয়েছে। অতীতে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের সব ধরনের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং তাদের অনেককে নিখুঁতভাবে হত্যাও করেছে।
আর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে কখনও কখনও এজেন্টদের মাধ্যমে সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকার স্থাপন করার পর ড্রোন হামলার মাধ্যমে। এমনকি মোবাইল ফোন বিস্ফোরণের মাধ্যমেও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী নেতাদের হত্যা করেছে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা।
আর একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে গাজা ও ইসরায়েলের উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত বেড়া বরাবর ক্যামেরা, মোশন সেন্সর স্থাপন করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সীমান্ত এলাকায় ইসরায়েলের নিয়মিত সেনা টহল রয়েছে। এই হামলার সময় যে ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা ঠেকাতে কাঁটাতারের বেড়ায় ‘স্মার্ট প্রতিবন্ধকতাও’ বসানো ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
তারপরও হামাসের যোদ্ধারা বুলডোজার দিয়ে সীমান্ত বেড়া গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েছে। শুধু তাই নয়, সীমান্তে গর্ত খুঁড়ে, সমুদ্রপথে এবং প্যারাগ্লাইডার ব্যবহার করে ইসরায়েলে প্রবেশ করেছে তারা।
ইসরায়েলিদের নাকের ডগায় হাজার হাজার রকেট মজুদ ও গোলাবর্ষণের মতো সমন্বিত ও জটিল আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি এবং হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হামাস যে নজিরবিহীন কৌশল ও নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা পরিষ্কার।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বিবিসির গার্ডনারকে বলেছেন, এই হামলার ঘটনায় তারা বড় ধরনের তদন্ত শুরু করেছেন। আর ইসরায়েলি গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তা আগামী কয়েক বছর ধরে চলবে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
গার্ডনার লিখেছেন, তবে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের কাছে অন্যান্য অগ্রাধিকারমূলক আরও অনেক বিষয় রয়েছে। ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্তে অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং দমন করতে হবে। সেই সঙ্গে হামাসের যোদ্ধাদের নির্মূল করতে হবে; যারা সীমান্ত বেড়া পেরিয়ে ইসরায়েলের কয়েকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের উদ্ধারের জন্য সশস্ত্র সামরিক অভিযান অথবা আলোচনার পথ বেছে নিতে হবে তেলআবিবকে। পাশাপাশি যেসব স্থান থেকে ইসরায়েলে রকেট ছোড়া হয়েছে সেসব স্থানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করতে হবে ইসরায়েলকে। যদিও এই কাজ প্রায় অসম্ভবই। কারণ হামাস হামলায় যে ধরনের রকেট ব্যবহার করেছে, সেগুলো কোনও ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই যেকোনও স্থান থেকেই ছোড়া যায়।
এবং সম্ভবত ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো: হামাস অস্ত্র চেয়ে যে আহ্বান জানিয়েছে তাতে অন্যদের সাড়াদান ঠেকাবে কীভাবে ইসরায়েল? এমনকি পশ্চিম তীরেও এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা এড়ানো কঠিন। শুধু তাই নয়, লেবাননের সাথে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তজুড়ে হিজবুল্লাহর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধারাও এই সংঘাতে যোগ দিতে পারে।
এসএস