কারাবাখে আত্মসমর্পণের পর আর্মেনিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ
ককেশাস অঞ্চলের দেশ আজারবাইজানের বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে আজারি বাহিনীর ব্যাপক হামলার পর আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে আর্মেনিয়াতে।
মূলত আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) হাজার হাজার বিক্ষোভকারী আর্মেনীয় রাজধানীতে জড়ো হন এবং প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের পদত্যাগ দাবি করেন। বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাবাখের আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর সদস্যরা আজারবাইজানের কাছে অপমানজনক আত্মসমর্পণে বাধ্য হওয়ার পরে আর্মেনিয়ান সরকারের ব্যর্থতার নিন্দা জানাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বুধবার আর্মেনীয় রাজধানীতে রাস্তায় নেমে আসেন।
এসময় বিক্ষোভকারীরা রাজধানী ইয়েরেভানের কেন্দ্রস্থলে রিপাবলিক স্কোয়ারে জড়ো হন। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকেই এদিন আর্মেনিয়ান প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের পদত্যাগ দাবি করেন। আর্মেনিয়ার এই প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের যুদ্ধে আজারবাইজানের কাছে পরাজয়ের সময়ও দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন এবং এখন তার নেতৃত্বেই কারাবাখে আর্মেনিয়ান কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত পতন হলো।
আজারবাইজানের ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতিগত আর্মেনীয় ছিটমহল নাগোরনো-কারাবাখ ঘিরে কয়েক মাস ধরে দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা চলছে। সম্প্রতি বিতর্কিত ওই ভূখণ্ডে মাইন বিস্ফোরণ ও অন্য এক ঘটনায় আজারবাইজানের ১১ পুলিশ সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন।
আর আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ওই অঞ্চলে গত মঙ্গলবার আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীর অভিযান পরিচালনার খবর পাওয়া যায়। মূলত সামরিক অভিযানের একদিনের মাথায় আজারবাইজানের বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে রাজি হয়।
উভয় দেশই চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে; যা বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে কার্যকর হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নাগোরনো-কারাবাখে আর্মেনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীকে নিরস্ত্র এবং ভেঙে দেওয়া হবে। এছাড়া ওই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এবং সেখানে বসবাসকারী জাতিগত আর্মেনীয়দের বিষয়ে বৃহস্পতিবার আলোচনা শুরু হবে।
স্বঘোষিত ‘আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র’ পরিচালনাকারী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বলেছেন, তারা আজারবাইজানের শর্তে রাজি হতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ বাকুর সেনাবাহিনী সীমান্তরেখা অতিক্রমের পর কৌশলগত কয়েকটি স্থাপনার দখল নেওয়ায় চুক্তিতে রাজি হওয়া ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না। আর এই সময়ে বিশ্ব কিছুই করেনি বলে অভিযোগ করেছেন আর্মেনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর সদস্যরা।
বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বলেছেন, ‘আর্টসাখ প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডের কাছ থেকে অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।’
এছাড়া আজারবাইজানও এই চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। চুক্তি ফলে নাগোরনো-কারাবাখের প্রায় এক লাখ ২০ হাজার জাতিগত আর্মেনীয়কে নিজেদের সমাজে একীভূত করে নেবে আজারবাইজান। কিন্তু অনেক আর্মেনীয় আজারবাইজানের এই পদক্ষেপের ব্যাপারে ভীত।
এদিকে আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অপমানজনক আত্মসমর্পণে বাধ্য হওয়ার পরই হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাজধানী ইয়েরেভানের কেন্দ্রস্থলে জড়ো হন। তাদের অনেকে আর্মেনিয়ান প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ৩২ বছর বয়সী সৌর প্রকৌশলী হারুত বলছেন: ‘আমরা আশা করি তিনি (নিকোল পাশিনিয়ান) পদত্যাগ করবেন। যুদ্ধে হেরে যাওয়া একজন নেতার পক্ষে পদে থাকার এবং দায়িত্বপালন চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।’
তিনি বলেন, আর্মেনীয়রা কারাবাখের জন্য কতদিন ধরে লড়াই করেছিল তা বিবেচনা করলে এই পরাজয়টি আরও বেদনাদায়ক আমাদের কাছে। তার ভাষায়, ‘আমরা গত ৩০ বছর ধরে এটার জন্য লড়াই করছি, মূলত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এবং এখন এটি আর আমাদের নয়।’
অন্যদিকে বিরোধী রাজনীতিবিদরা পাশিনিয়ানের নিন্দা জানিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। এছাড়া রিপাবলিক স্কোয়ারে কয়েকজন বিক্ষোভকারী ‘নিকোল বিশ্বাসঘাতক!’ বলেও স্লোগান দেন।
রয়টার্স বলছে, বিক্ষোভের সময় অনেকেই নাগোরনো-কারাবাখের পতাকা সাথে রেখেছিলেন এবং কেউ কেউ পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তিও করেন। অন্যরা রিপাবলিক স্কোয়ারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় লক্ষ্য করে বোতল ও পাথর ছুড়ে মারেন।
অবশ্য বিক্ষোভের শঙ্কায় দাঙ্গা পুলিশ আগেই সরকারি অফিসগুলো সিল করে দিয়েছিল।
উল্লেখ্য, বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান কয়েক দশক ধরে বিবাদে লিপ্ত রয়েছে। নাগোরনো-কারাবাখ আজারবাইজানের ভূখণ্ডের ভেতরে অবস্থিত হলেও ১৯৯৪ সালের এক যুদ্ধের পর থেকে আর্মেনিয়ার সমর্থনে জাতিগত আর্মেনীয় বাহিনী ওই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
ইতোমধ্যে নাগোরনো-কারাবাখ ঘিরে দুই প্রতিবেশী আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়া অন্তত দুবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রথমবার যুদ্ধে জড়ায় দেশ দুটি।
সাবেক সোভিয়েত এ দুই রাষ্ট্র বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে ২০২০ সালে ফের প্রাণঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দুই দেশের সৈন্যদের হামলা-পাল্টা হামলায় সেই যুদ্ধে উভয়পক্ষের সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
আর্মেনিয়া বলছে, কারাবাখে তাদের কোনও সামরিক বাহিনী নেই। এমনকি সেখানে কোনও ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপও করা হয়নি। কিন্তু আজারবাইজান বরাবরই বলে আসছে, আর্মেনিয়ার সামরিক বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা চেষ্টা করছে।
তবে বুধবারেই এই চুক্তি অনুযায়ী জাতিগত আর্মেনীয়রা কারাবাখে আজারি নিয়ন্ত্রণে থাকবেন নাকি আর্মেনিয়ায় চলে যাবেন, সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।
অবশ্য আজারবাইজানের সামরিক অভিযানে কারাবাখে বহু নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছেন। নাগোরনো-কারাবাখের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনিয়ান মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তা গেঘাম স্টেপানিয়ান বলেছেন, বিচ্ছিন্ন ওই অঞ্চলে আজারবাইজান হামলায় কমপক্ষে ২০০ জন নিহত এবং আরও ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
এছাড়া নিহতদের মধ্যে অন্তত ১০ জন বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন যাদের মধ্যে পাঁচজন শিশু বলেও স্টেপানিয়ান দাবি করেছেন।
টিএম