বিধ্বস্ত মরক্কোয় যৌন হয়রানি-বাল্যবিয়ে-পাচারের ঝুঁকিতে মেয়েরা
ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত মরক্কোর অবিবাহিত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী-তরুণীরা নতুন এক বিপদে পড়েছেন। দিন দিন তাদের বাল্যবিয়ে- যৌন হয়রানি ও পাচারের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানা গেছে।
আর এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মরক্কোর নেটিজেনদের একটি অংশ নানাভাবে পুরুষদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, ভূমিকম্পের জেরে বর্তমানে দেশটির পশ্চিম ও উত্তরপশ্চিাঞ্চলীয় অঞ্চলের দুর্গম বিভিন্ন এলাকার তরুণী-কিশোরীরা এখন খুবই বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন এবং তাদের ‘রক্ষা’ করার জন্যই এখন তাদের বিয়ে করা ‘জরুরি’।
সম্প্রতি এক নেটিজেন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ভূমিকম্পবিধ্বস্ত একটি এলাকার এক কিশোরীর ছবি পোস্ট করেছেন। ছবিটির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন— ‘এই মেয়েটি বলেছে যে সে আমাকে ভালবাসে। যদিও সে আমাকে বলেছে যে, এখন সে এখন আমার সঙ্গে আমার শহর কাসাব্লাঙ্কায় আসতে ইচ্ছুক নয়; কিন্তু কানে কানে মেয়েটি আমাকে বলেছে যে, যখন সে বড় হবে— আমরা বিয়ে করব।’
ভূমিকম্প উপদ্রুত বিভিন্ন এলাকার কিশোরী-তরুনীদের ‘উদ্ধার’ করতে তাদেরকে বিয়ে করার পক্ষে জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণায় নেমেছে মরক্কোর বেশ কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ। দেশটির জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ ‘সিটি গার্লস’ও সেগুলোর মধ্যে একটি।
সিটি গার্লসের পেজে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আপনি এমন কোনো নষ্ট নারীকে কেন বিয়ে করবেন যে আঁটসাঁট পোশকা করে শরীর প্রদর্শন করবে, বেহিসেবীভাবে আপনার অর্থ ব্যয় করবে এবং আপনার সন্তানকে বাজেভাবে মানুষ করবে? বরং এমন নারীদের বিয়ে করা উচিত, যে কখনও কোনো কিছু চাইবে না আপনার কাছে।’
মরক্কোর সরকার অবশ্য এই বিষয়ে তৎপর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের ‘দাওয়াত’ ছড়ানোর অভিযোগে গত সপ্তাহে ২০ বছর বয়সী এক তরুণকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। ২০ বছর বয়সী ওই তরুণ ভূমিকম্প মরক্কোর ভূমিকম্প বিধ্বস্ত অন্যতম শহর ইরাশিদিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সেখানে যাওয়ার আগে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেছিলেন, বিপদগ্রস্ত তরুণী-কিশোরীদের ‘উদ্ধার’ করতে যাচ্ছেন তিনি।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১ টার দিকে পর পর দু’টি ভূমিকম্প আঘাত হানে মরক্কোতে। রিখটার স্কেলে প্রথমটির মাত্রা্ ছিল ৬ দশমিক ৮ এবং দ্বিতীয়টির মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৮। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে উচ্চ অ্যাটলাস পর্বতমালা ঘেঁষা প্রদেশ আল হাউজের পার্বত্য শহর ইঘিলের ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্প দু’টির উৎপত্তিস্থল।
এই ভূমিকম্পে কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে মরক্কোর চতুর্থ বৃহত্তম এবং পর্যটন শহর মারাকেশ ও তার আশপাশের গ্রাম-শহরসহ দেশটির পুরো পশ্চিমাঞ্চল। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২৯ হাজারেরও বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই ভূমিকম্প।
এদিকে, ভূমিকম্পের পর মরক্কোর বিধ্বস্ত বিভিন্ন শহর ও গ্রামে নারীরা যে বিভিন্ন গুরুতর সংকটে ভুগছেন, তা জানা গেছে সেখানকার বিভিন্ন এনজিও ও নারী অধিকার সংস্থাগুলোর বরাতে। এসব সংকট বাল্যবিবাহ-যৌন হামলা ও পাচারের মতো অপরাধের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকেই।
পার্বত্য এলাকার গ্রাম ও শহরে বেশ কয়েকজন কিশোরী-তরুণীর সন্ধান গত কয়েকদিন ধরে মিলছে না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা পাচারের শিকার হয়েছে।
কিশোরী-তরুনীদের পাচার ঠেকাতে গত সপ্তাহে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ এক ভাষণে জানিয়েছেন, যেসব শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী ভূমিকম্পে নিজেদের পিতা-মাতা-অভিভাবকদের হারিয়েছে, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুরক্ষা দেওয়া হবে।
এছাড়া মারাকেশভিত্তিক এনজিও আল কারাম অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কারিমা এমকিকা জানিয়েছেন, তার সংস্থা ইতোমধ্যে একটি হটলাইন পরিষেবা চালু করেছে। পশ্চিমাঞ্চলের দুর্গম এলাকাগুলোতে কোনো কিশোরী বা তরুণী যদি নিখোঁজ হন, সেক্ষেত্রে তার পরিবারের সদস্যরা এই হটলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে তা জানাতে পারবেন এবং সেসব তথ্য সরাসরি হস্তান্তর করা হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
মরক্কোর নারী অধিকারকর্মী ইয়াসমিনা বেনস্লিমানে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত গ্রাম- শহরগুলোতে এখনও খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। সেসব পরিবারের নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। এছাড়া এত বড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। ফলে যেসব সৌভাগ্যবান পরিবার তাঁবুতে রাত কাটাচ্ছেন, তারাও তেমন নিরাপদে নেই।
ঋতুচক্রজনিত পরিচ্ছন্নতা উপকরণ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় উপদ্রুত বিভিন্ন এলাকায় নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। মারাকেশভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আমাল ওম্যান’সের প্রশিক্ষক নোরা ফিটজেরাল্ড কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘মরোক্কোর দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড সহজলভ্য নয়। এ কারণে সেখানকার অধিকাংশ নারী মাসের বিশেষ দিনগুলোতে ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।’
‘একবার ব্যবহারের পর ধুয়ে সেসব ন্যাকড়া পুনরায় ব্যবহার করেন তারা। কিন্তু ভূমিকম্পের পর বেশিরভাগ এলাকার শৌচাগার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে ন্যাকড়া পরিষ্কারের সুযোগ নেই। ফলে উপদ্রুত বিভিন্ন এলকার নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
গর্ভবতী নারীরাও ব্যাপক সংকটের মধ্যে রয়েছেন বলে জানা গেছে। সরকারি-বেসরকারী তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ১০০ গর্ভবতী নারী। তাদের মধ্যে গত প্রায় দু’সপ্তাহে অনেকে ইতোমধ্যে সন্তানের জন্মও দিয়েছেন অনেকে, কিন্তু মাতৃকালীন কোনো সেবা তারা পাচ্ছেন না।
জাতিসংঘের জনকল্যানমূলক তহবিল ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ডের (ইউএনএফপিএ) মরক্কো শাখার প্রধান লায়লা বাকের জানিয়েছেন, মরক্কোর সরকার সাধ্যমত ত্রাণ সরবরাহের চেষ্টা করছে; কিন্তু জাতিসংঘ থেকে প্রয়োজনী সহায়তা ও সরবরাহ আসছে না।
‘ইউএনএফপিএ এখন লিবিয়ার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, কারণ সেখাকার অবস্থাও ভয়াবহ,’ বলেছেন লায়লা।
সূত্র : আলজাজিরা
এসএমডব্লিউ