কুয়েতে টিকাদানে অবহেলিত প্রবাসীরা, ক্ষোভ
উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ ক্ষুদে রাষ্ট্র কুয়েতের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে বিদেশিদের বিবেচনা করা হলেও করোনাভাইরাস মহামারিতে টিকার জন্য বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারা। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই বিদেশি এবং কুয়েতের সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের অবদান বেশি হলেও টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় একেবারে পেছনে থাকায় অনেকেই ক্ষুব্ধ।
হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানোর জন্য উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য অনেক দেশ বিদেশি কর্মীদের গণ-টিকাদান শুরু করলেও উল্টো নীতি নিয়েছে কুয়েত। নাগরিকদের ভ্যাকসিন আগে দেওয়ার নীতি নেওয়ায় কুয়েতের সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
মহামারির উল্লম্ফনের মাঝে কুয়েতিদের বাড়িঘর পরিষ্কার, সন্তানদের দেখাশোনা, গাড়ি চালানো, গৃহস্থলী পণ্য-সামগ্রী কেনাকাটার কাজ এশিয়া, আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের প্রবাসীরা করছেন। কিন্তু এই প্রবাসীরা এখনও দেশটিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
কুয়েতে করোনা টিকাদান কর্মসূচিতে প্রবাসীরা যে উপেক্ষিত হচ্ছে সেবিষয়ে মার্কিন বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সরকারের শাস্তির আশঙ্কায় দেশটিতে কর্মরত অনেক প্রবাসী তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
২৭ বছর বয়সী এক কুয়েতি চিকিৎসক এপিকে বলেন, আমি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে যাদের দেখেছি; তারা সবাই কুয়েতি।
তিনি বলেন, কুয়েতে সবক্ষেত্রেই নাগরিক-প্রথম নীতি রয়েছে; এমনকি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও। করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের টিকাদান কৌশলের ব্যাপারে জানতে কুয়েতি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পায়নি এপি।
গত বছরের ডিসেম্বরে কুয়েতে টিকা নিবন্ধনের ওয়েবসাইট উদ্বোধনের পর দেশটির কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য-সেবা কর্মী, বয়স্ক এবং অন্যান্য জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন— এমন ব্যক্তিরা সবার আগে নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন বলে ঘোষণা দেয়। কয়েক সপ্তাহ পর এটি ক্রমবর্ধমান হারে পরিষ্কার হয়ে যায়— স্বাস্থ্য অথবা বয়স নয়; বরং বাছ-বিচারহীনভাবে শুধুমাত্র কুয়েতিরাই এই টিকার সিংহভাগ ডোজ পাচ্ছেন। দেশটিতে কর্মরত প্রবাসী মেডিকেল কর্মীরা বলছেন, এমনকি তারাও টিকার নিবন্ধন করতে পারছেন না।
কুয়েতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। দেশটিতে এই প্রবাসীদের বেশিরভাগ সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে বৈরী আচরণেরও নজির রয়েছে কুয়েতের।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর কুয়েতের তৎকালীন সরকার ফিলিস্তিন, জর্ডান এবং ইয়েমেনি শ্রমিকদের গণহারে ফেরত পাঠায়। উপসাগরীয় অঞ্চলের এই যুদ্ধে ইরাকের প্রতি সমর্থন জানায় এ কয়েকটি দেশ। কুয়েতে শ্রমিকশূন্যতা হ্রাস করতে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ শ্রমিক ছুটে যান কুয়েতে।
স্বনির্ভর কুয়েত গড়তে যে শ্রমিকরা যুগের পর যুগ লড়াই করছেন; সেই শ্রমিকরাই এখন দেশটিতে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন।
৩০ বছর বয়সী ভারতীয় এক নারী তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন কুয়েতে। ইন্সটাগ্রামে তিনি কুয়েতের কিশোর-কিশোরীদের ভ্যাকসিন নেওয়ার অসংখ্য ছবি দেখছেন। কিন্তু ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে থাকা তার ৬২ বছর বয়সী বাবা এখনও করোনার টিকা পাননি। এমনকি তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের কেউই এখনও করোনার টিকা পাননি।
তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিত সব কুয়েতিই ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন। এটা শুধুমাত্র বিরক্তিকরই নয়; বরং তারচেয়েও বেশি কিছু। আমি যে এখানে বসবাস করছি; এখন এটি কল্পনা করারও কোনো উপায় নেই। আমি বা আমরা কিছুই নই।’
চলতি বছরের শুরুর দিকে কুয়েতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যারা দেশটির নাগরিক নন; তাদের তুলনায় নাগরিকরা ছয়গুণ বেশি হারে টিকা পেয়েছেন। ওই সময় পর্যন্ত অনলাইনে টিকার জন্য প্রায় ২ লাখ ৩৮ হাজার প্রবাসী নিবন্ধ করেন; যাদের মধ্যে মাত্র ১৮ হাজার জন টিকা নেওয়ার ডাক পান। তবে তাদের বেশিরভাগই চিকিৎসক, নার্স এবং রাষ্ট্রীয় কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মী। কিন্তু ততক্ষণে দেশটির এক লাখ ১৯ হাজার নাগরিক করোনা টিকা পান।
৩০ বছর বয়সী লেবাননের নাগরিক; যিনি বেড়ে উঠেছেন কুয়েতে। তিনি বলেন, এই বৈষম্য এখানে আমাদের জন্য নতুন নয়। মহামারি এই বৈষম্যের ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরেছে মাত্র। লেবাননী এই নারীর আত্মীয়-স্বজনরাও এখনও করোনা টিকার অপেক্ষা করছেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু এটাই আমাদের জীবন এবং মৃত্যু। আমি আসলে কখনই চিন্তা করতে পারি নাই যে, এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে।’
৪২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের এই দেশটিতে রোববার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৯জন। এছাড়া এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন এক হাজার ৩৩৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২ লাখ ২০ হাজার ৫০০ জনের বেশি।
এসএস