চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে এত আগ্রহ কেন?
বর্তমানে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে তীক্ষ্ণ নজর গোটা বিশ্বের। কয়েকদিন আগেই সেই দক্ষিণ মেরু জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। তবে বুধবার (২৩ আগস্ট) বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয় করে ফেলেছে ভারতের চন্দ্রযান-৩। ভারতের এই অভিযানের দিকে তাকিয়ে ছিল বিশ্বের সব দেশ ও মহাকাশ সংস্থাগুলো।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এ অঞ্চলটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -২০০ ডিগ্রিতে নামতে পারে। তাপমাত্রার এমন তারতম্যের কারণে এখানে সফলভাবে অভিযান চালানো বেশ কঠিন। সে কারণেই ভারতের আগে চাঁদের এ অংশের মাটি ছুঁতে পারেনি কোনো দেশ।
তবে প্রশ্ন আসতেই পারে চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে কেন এত উৎসাহ?
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই জলের অনু দিয়ে তৈরি বরফের সন্ধান মিলেছ। এই অংশে রয়েছে প্রচুর খনিজের সম্ভার। চাঁদে বাসযোগ্য নগরী তৈরি, চাঁদের খনিজ আহরণ এবং মঙ্গল অভিযানের বেসক্যাম্প তৈরির ভাবনাও রয়েছে চাঁদের এ মেরুকে ঘিরে।
২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ তো বটেই আগেও একাধিক চন্দ্রাভিযানে চাঁদের এই অংশে জলের উপস্থিতি নজরে এসেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রাচীন এই জল-বরফ থেকে চাঁদ সৃষ্টির বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য জানা যেতে পারে। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে সেখানে জলের উৎস থাকে, তবে পানীয় জল পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
এই জল ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন উৎপন্ন সম্ভব হলে জ্বালানি হিসেবে ও শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে।
এছাড়া চাঁদের এই অংশের বুকে লুকানো অসীম মূল্যবান খনিজ সামগ্রীর ওপরও নজর রয়েছে।
চাঁদের গহ্বর বা ক্রেটারে খনিজের ছড়াছড়ি। ‘মুন মিনারালোজি ম্যাপার ইনস্ট্রুমেন্ট (এম-থ্রি)’ দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে হদিশ মিলেছে বিভিন্ন খনিজের। এই হদিশ দিয়েছিল চন্দ্রযান-১। ২০০৯ সাল থেকে নাসার ‘লুনার ক্রেটার অবজারভেশন অ্যান্ড সেন্সিং স্যাটেলাইট’র সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল এলআরওকে। ১০০ মিটার রেজোলিউশনে চাঁদের পিঠের ৩-ডি ম্যাপিং করেছে এলআরও। সেখানেই ধরা পড়েছে, চাঁদের পৃষ্ঠের ০.৫ মিটার থেকে ২ মিটার গভীরে জমে আছে লোহা ও টাইটেনিয়াম অক্সাইড। চাঁদের গহ্বরগুলোতেও খোঁজ মিলেছে ধাতুর।
চাঁদের পৃষ্ঠে কী কী খনিজ রয়েছে তার সন্ধান করতেই ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডার বিক্রম ও রোভারকে পাঠিয়েছিল ইসরো। কিন্তু চাঁদের মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিক্রম-২। সেবার ব্যর্থ হয় মিশন। তবে এবারের মিশন সফল হয়েছে। চন্দ্রযান-৩ এর রোভার সেই একই কাজ করবে। কাজ হবে চাঁদের রুক্ষ, পাথুরে পৃষ্ঠে ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম ও টাইটেনিয়ামের মতো খনিজ রয়েছে কিনা তার সন্ধান করা।
বিজ্ঞানীরা খোঁজ পেয়েছেন যে, চাঁদের পৃষ্ঠে রয়েছে লোহা ও টাইটেনিয়াম অক্সাইড। চাঁদের পিঠে এক একটি বড় গহ্বরে যার পরিধি প্রায় ৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি, সেখানেই জমে থাকতে পারে লোহা ও টাইটেনিয়াম অক্সাইডের মতো মূল্যবান ধাতু। চাঁদের পিঠে ধাতুর খোঁজের সঙ্গেই তড়িদাহত কণাদের লাফালাফিও প্রত্যক্ষ করেছে এলআরও। চাঁদের ক্রেটার বা গহ্বর জুড়ে থাকে ধুলো বা রেগোলিথ। এই ধুলোতেই মিশে থাকে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, টাইটেনিয়াম ও আয়রনের মতো খনিজ পদার্থ।
১৯৬৭ সালে ইউনাইটেড নেশনের বহির্বিশ্ব চুক্তি বা আউটার স্পেস ট্রেইটি অনুযায়ী, কোনো দেশ চাঁদকে নিজেদের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করতে পারবে না। তবে চাঁদের বুকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালানোর ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রংরা নেমেছিলেন চাঁদের উত্তর মেরুর একটি অংশে। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত চাঁদে যে কয়েকটি সফল অভিযান হয়েছে সবই চাঁদের নিরক্ষীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। এই প্রথমবার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা পড়ল ভারতের।
কেএ