ল্যাব নয়, করোনার উৎস প্রাণীই: ডব্লিউএইচও
বিশ্বজুড়ে মহামারি ডেকে আনা করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে অন্য কোনও প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়িয়ে থাকতে পারে। করোনার উৎপত্তির এটিই সবচেয়ে সম্ভাব্য এক দৃশ্যপট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও চীনের বিজ্ঞানীদের যৌথ অনুসন্ধানের খসড়া প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে।
ডব্লিউএইচও এবং চীনা বিজ্ঞানীদের করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানের এই খসড়া প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে মার্কিন বার্তাসংস্থা এসোসিয়েট প্রেস (এপি)। ওই প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস একটি ল্যাব থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে এতদিন যে গুঞ্জন ছিল; সেটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ল্যাব থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
বিজ্ঞানীদের এই অনুসন্ধানের ফল মোটামুটি প্রত্যাশিতই ছিল। তবে অনেক প্রশ্নের উত্তর থেকে গেছে অজানা। ডব্লিউএইচও এবং চীনা বিজ্ঞানীদের ওই দল ল্যাব থেকে করোনার ছড়িয়ে পড়ার পূর্বানুমান ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে আরও গবেষণার প্রস্তাব দিয়েছেন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বারবার পিছিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণে মহামারির দায় চীনের ওপর চাপানো ঠেকাতে করোনার উৎপত্তি নিয়ে বিজ্ঞানীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাল্টাতে চীনা পক্ষ চেষ্টা করছে কি না সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়।
গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হতে পারে বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন।
সোমবার ডব্লিউএইচওর সদস্য একটি দেশের জেনেভাভিত্তিক কূটনীতিকের কাছ থেকে প্রতিবেদনের প্রায় চূড়ান্ত সংস্করণটি পেয়েছে মার্কিন বার্তাসংস্থা এপি। চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে মধ্য-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হওয়া চীনের হুবেই প্রদেশের উহান সফর করেন। সেখানে প্রায় এক মাস ধরে অনুসন্ধানের পর করোনার উৎপত্তি নিয়ে তারা এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন।
করোনার উৎপত্তি নিয়ে ডব্লিউএইচও এবং চীনা বিজ্ঞানীদের তৈরি ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পরিবর্তন আনা হবে কি না তা এখনও পরিষ্কার নয়। এছাড়া ওই কূটনীতিকও তার পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার আগে এই প্রতিবেদন প্রকাশের অনুমতি তার নেই।
গবেষকরা সম্ভাবনার ক্রম অনুযায়ী করোনার উৎপত্তির সম্ভাব্য চারটি পরিস্থিতি তালিকাভুক্ত করেছেন। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, দ্বিতীয় একটি প্রাণীর মাধ্যমে সংক্রমণের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের বিস্তার মূল্যায়ন করেছেন তারা। বলেছেন, কোল্ড চেইন খাদ্য পণ্যের মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি।
বাদুড়ের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর ভাইরাসটির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়গোত্রীয় দ্বিতীয় কোনো প্রাণী এর বাহক ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাদুড় ভাইরাস এবং সার্স-কোভ-২ এর মধ্যে বিবর্তনীয় দূরত্ব রয়েছে; যা কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান বলে ধারণা করা হয়। তবে এর মধ্যে সংযোগকারীর অনুপস্থিতি দৃশ্যমান।
ডব্লিউএইচও-চীনা বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একেবারে অনুরূপ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে প্যাঙ্গোলিনের দেহে। মিঙ্ক (বেঁজির মতো দেখতে এক ধরনের প্রাণী) এবং বিড়ালকেও কোভিড ভাইরাসের জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে। এই দুই প্রাণীও ভাইরাসের বাহক হতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
উহান মিশনে নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পিটার বেন এমবারেক শুক্রবার বলেছেন, প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং এই প্রতিবেদনের তথ্য যাচাই-বাছাই এবং অনুবাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি প্রত্যাশা করছি, পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এবং আমরা এটি প্রকাশ করতে সক্ষম হবো।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানের একটি সামুদ্রিক খাবার বিক্রির বাজারে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। চীনের গণ্ডি পেরিয়ে দ্রুতগতিতে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরের বছরের ১১ মার্চ করোনা প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান ড. টেড্রস আধানম গেব্রেইয়েসুস।
বৈশ্বিক এই মহামারি মোকাবিলায় নজিরবিহীন গতিতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে প্রয়োগও শুরু হয়েছে।
ব্লুমবার্গের ভ্যাকসিন ট্র্যাকার বলছে, বিশ্বের ১৪১টি দেশে ৫৩ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছেন।
করোনাভাইরাস মহামারির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে আসা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস বলছে, বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে সোমবার পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৯৭ হাজার ছাড়িয়েছে এবং মারা গেছেন ২৭ লাখ ৯৬ হাজারের বেশি। তবে আক্রান্তদের মধ্যে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৩ হাজার ৩৯৩ জন।
এসএস