রুশ বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন নেপালিরা?
উন্নত জীবনের আশায় শিক্ষার্থী ভিসায় নেপাল থেকে রাশিয়ায় এসেছিলেন রমেশ। নেপালে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এই তরুণ কোনোভাবে চেয়েছিলেন এ থেকে মুক্তি পেতে।
পড়াশোনা শেষে হয় তাকে নেপালে ফিরে গিয়ে সাধারণ কোন চাকরি করতে হতো কিংবা রাশিয়ায় ভালো কোন চাকরি খুঁজতে হতো। কিন্তু নেপালে তার জন্য চাকরি পাওয়া মোটেও সহজ ছিল না।
নেপাল সরকারের এক সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭-১৮ সালে দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিল ১১.৪ শতাংশ। এর আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে , নেপালের বেশিরভাগ চাকরি অসংগঠিত খাত সংশ্লিষ্ট , যেখানে যথেষ্ট বেতন মেলে না।
বিবিসি নেপালির সঙ্গে এক অনলাইন আলাপচারিতায় রমেশ বলেন, ‘আমার মতো রাশিয়ায় আসা অন্য ছাত্ররা একই দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালো কোন চাকরি পাচ্ছে না।’
রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে টিকটক ভিডিও
রমেশ এবং তার মতো নেপালের আরও অনেকে যখন এমন এক সংশয়ের সাথে লড়াই করেছিলেন সে সময়ই ইউক্রেনের বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রুশ বাহিনী। গত দেড় বছর ধরে চলা যুদ্ধে রুশ বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। হাজার হাজার রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে ইতোমধ্যে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার আইনপ্রণেতারা রুশ আইনে কিছু পরিবর্তন আনেন, যেন সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের যোগদান সহজ ও আকর্ষণীয় হয়। যেসব বিদেশি সেনা রুশ বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, তাদেরকে প্রায় লাল গালিচা বিছিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে মস্কো।
পরিবর্তিত রুশ আইন অনুসারে, ইউক্রেন যুদ্ধে যেসব বিদেশি রুশ বাহিনীর পক্ষে যোগ দেবেন— তাদের মোটা অংকের বেতন থেকে শুরু করে রাশিয়ার নাগরিক হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করবে সরকার।
বিবিসি নেপলিকে রমেশ জানিয়েছেন, নতুন আইন পাসের পর তিনি রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের লাভজনক প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষা এবং মেডিকেল পরীক্ষার পরে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে নির্বাচিত হন।
তিনি আরও জানান, এই গোটা প্রক্রিয়ায় এক লাখ নেপালি রুপি ব্যয় করেছেন, তবে তিনি কাকে এই অর্থ প্রদান করেছেন তা প্রকাশ করেননি।
‘[নথিভুক্তির] আবেদন ও যোগদানের কাজটি আস্থার ভিত্তিতে করা হয়,’ বিবিসি নেপালিকে বলেছেন রমেশ।
চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পর রমেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে ভিডিওবার্তার মাধ্যমে তার সেনাবাহিনীতে যোগদানের খবর ছড়িয়ে দেন। সংক্ষিপ্ত সেই রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার নানা উপায়ের কথা তুলে ধরা হয়।
নিজের টিকটক অ্যাকাউন্টে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ভিডিও পোস্ট করেছেন রমেশ। সেসব ভিডিওতে তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত নেয়া তার জন্য কতোটা কঠিন ছিল।
‘একজন সৈনিকের কাজ হল—হয় করো না হলে মরো। আপনি যদি এমনটা করতে চান তবেই (রুশ বাহিনীতে) যোগ দিন।’ নেপালের তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে পোস্ট করা এক ভিডিওতে এমন বার্তা দিয়েছেন তিনি।
‘তথ্যমূলক’ শিরোনামের অন্য একটি ভিডিওতে তিনি বলেছেন, ‘এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আপনি যা আশা করবেন তেমনটা হবে না। আমি মনে করি এটা জীবনের কঠিন দিক। কারণ এই দেশটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করছে।’
সেনাবাহিনীতে যোগদানের 'কাউন্সেলিং সার্ভিস'
বিবিসি শেষবার যখন রমেশের সাথে যোগাযোগ করে, তখন তিনি বলেছিলেন যে তার কাছে খুব কম সময় আছে কারণ তাকে প্রশিক্ষণের জন্য বেলারুশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর থেকে বিবিসি তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি।
তারপর এক সপ্তাহের দীর্ঘ তদন্তে, বিবিসি নেপালি দেখতে পেয়েছে যে রমেশই একমাত্র নেপালি নন যিনি রাশিয়ান বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
রাজ নামের আরেক নেপালি তরুণও শিক্ষার্থী ভিসায় উচ্চ শিক্ষার জন্য রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। মস্কো যখন ২০২২ সালের এপ্রিলে তাদের সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘোষণা করে, তখন অনেক নেপালি তরুণ মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য একটিই— তারা সবাই রুশ বাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক এবং তারা চান— রাজ যেন রুশ ভাষায় ফর্ম পূরণ করতে তাদের সহায়তা করেন। কারণ, তাদের প্রায় কেউই রুশ ভাষা জানেন না।
‘আমি কিছু নেপালি তরুণকে রুশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর আবেদনপত্র পূরণের জন্য সাহায্য করেছিলাম, যাদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। বর্তমানে, তারাই রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে ইচ্ছুকদের আমার ফোন নম্বর দিচ্ছেন,’ বিবিসিকে বলেন তিনি।
রাজ মূলত রাশিয়ায় পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আসতে ইচ্ছুক নেপালি শিক্ষার্থীদের পরামর্শদাতা বা কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করতেন; এখন রাশিয়ান সেনা পদে যোগদানের জন্য প্রাক্তন নেপালি সৈন্য এবং ছাত্ররা তার কাছে সাহায্য চাইতে আসেন।
বিবিসিকে রাজ জানান, প্রতিদিন তিনি ৪০-৫০টি ফোন কল পান এবং কলদাতাদের বেশিরভাগই জানতে চায়—কীভাবে তারা রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
যেসব নেপালি তরুণ যারা তাদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদানের ভিডিও পোস্ট করেছিল, তারাও জানিয়েছেন— এ ব্যাপারে রাজের সহায়তা নিয়েছেন তারা।
বিবিসিকে রাজ বলেছেন, নেপালিদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া অবৈধ কিনা তা তিনি জানেন না। তিনি আরও বলেছেন, তিনি তার সেবার জন্য কোনও অর্থও গ্রহণ করেন না – তবে কিছু নেপালি যারা তার সাহায্য নিয়েছিলেন, তারা দাবি করেছেন যে তারা প্রত্যেকে তাকে এক লাখ করে নেপালি রুপি দিয়েছে৷
নেপালের সরকারের নিয়ম কানুন কি বলে?
রাশিয়া ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধের নিন্দা জানিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো নেপালের সরকার জানিয়েছে, নেপালি নাগরিকদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া সম্পর্কিত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
তবে যদি সত্যিই এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আসে, সেক্ষেত্রে এই ব্যাপারটিকে সমর্থন করা হবে না বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকারের প্রতিনিধিরা।
নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেওয়া লামসাল বিবিসি নেপালিকে বলেছেন, ‘এটি আমাদের নীতির সঙ্গে যায় না।’
১৯৪৭ সালে নেপালি নাগরিকদের বিদেশি সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিষয়ে ব্রিটেন, নেপাল এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তিতে চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে নেপালি নাগরিকদের ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে।
একইসঙ্গে এ ও উল্লেখ করা হয়েছে যে যেসব নেপালি তাদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেবে সেখানে তাদেরকে ‘ভাড়াটে’ হিসেবে গণ্য করা হবে না।
এর বাইরে অন্য কোনও দেশের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে নিজ দেশের নাগরিকদের সমর্থন করার কোনও নীতি সরকারের নেই।
রুশ বানিহীতে নেপালিদের যোগদানের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে মস্কোতে কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রদূত মিলনরাজ তুলাধারের সাথে যোগাযোগ করেছে।
‘(নেপাল থেকে) যারা রাশিয়ায় বেড়াতে বা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আসেন তারা অন্য নানা কাজে নিয়োজিত হতে পারেন না। নেপালের শুধুমাত্র ভারত এবং ব্রিটেনের সঙ্গে সেনা নিয়োগ সম্পর্কিত একটি চুক্তি রয়েছে; রাশিয়ার সাথে এ বিষয়ক কোন চুক্তি আমাদের নেই,’ তুলাধার বলেন।
তবে তিনি জানিয়েছেন, টিকটকে পোস্ট করা ভিডিওগুলো এখনও যাচাই করা যায়নি।
বিবিসির অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে
বিবিসি এরকম কিছু টিকটক ভিডিও সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, রাশিয়ার ভেতরে যেখানে সামরিক ক্যাম্প রয়েছে এমন এলাকা থেকে পোস্ট করা হয়েছে সেগুলো।
কিছু অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা বিভিন্ন নথি বিবিসি রুশ সার্ভিসের মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে। বিবিসি রুশ সার্ভিসের সাংবাদিক আন্দ্রে কোজেনকো অন্তত দুটি অ্যাকাউন্ট চেক করেছেন যেখানে রাশিয়ার সামরিক নথির ছবি পোস্ট করা হয়েছে।
‘আমাদের হাতে আসা দুটি নথি থেকে জানা গেছে, ওই দুই যুবক রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে রয়েছে,’ কোজেনকো বলেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সামরিক পদমর্যাদা, পুরো নাম ও অভিভাবকের নাম ওই নথিতে প্রকাশ করা হয়। নথিতে তারা যে সামরিক ইউনিটগুলোর জন্য কাজ করে সে সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে।
বিবিসি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে জানতে কাঠমান্ডুতে রাশিয়ান দূতাবাসের সাথে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছে। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
কেন রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন নেপালি তরুণরা?
নেপালের সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের উপযোগী কর্মসংস্থান ও ভালো সুযোগের অভাবই দেশটির তরুণদের বাধ্য করছে বিদেশি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক টিকারাম গৌতম বলেন, ‘নেপালিরা পড়াশোনা বা বেড়াতে যাওয়ার অজুহাতে বিদেশে গেলেও, তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে সেখানে গিয়ে কাজ করা এবং উপার্জন করা।’
এই তরুণদের রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীতে তারা কয়েক মাসে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে তার সমপরিমাণ আয় কোন খাত থেকে করতে গেলে অন্তত কয়েক বছর সময় লাগতো।’
নেপাল সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে রাশিয়ায় গিয়েছে অন্তত ১ হাজার ৭২৯ জন নেপালি তরুণ।
দেশটির অভিবাসন বিভাগের তথ্য মতে, এই ১ হাজার ৭২৯ জনের মধ্যে ৭৪৯ জন শিক্ষার্থী হিসেবে রাশিয়ায় গিয়েছেন এবং বাকি ৩৫৬ জন গিয়েছেন চাকরির উদ্দেশ্যে।
রাশিয়ায় অবস্থানরত যে নেপালিদের সাথে বিবিসি কথা বলেছে, তাদের বক্তব্যেও ঘুরে ফিরে মি. গৌতমের যুক্তি উঠে আসছে।
‘আমরা এখানে টাকার জন্য এসেছি,’ এমনটাই বলেছেন রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া এক ব্যক্তি। এবং এ নিয়ে তিনি টিকটকে একটি ভিডিও করেছেন।
‘আমাদের এখানে যা অফার করা হয় আমরা সেটা নেপালে উপার্জন করতে পারি না। আপনি অন্য দেশেও এত পরিমাণ উপার্জন করতে পারবেন না। আপনাদের যাদের হৃদরোগের সমস্যা নেই তারা এখানে আসতে পারেন,’ তিনি বলেন।
আরেকজন যুবক বিবিসিকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ‘আমরা যদি আমাদের জীবনের মায়ায় নেপালে ফিরে আসি, সেখানে কী আমরা চাকরি পাব?’
রুশ বাহিনীতে কত বেতন পাচ্ছেন নেপালিরা?
যেসব বিদেশি সেনা ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করবে তাদেরকে আরও বেশি বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাশিয়ার সরকার।
বিবিসিকে রাজ জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণের সময় নেপালিদের ৬০ হাজার নেপালি রুপির সমান বেতন দেওয়া হয়।
আরেকজন, যিনি রুশ বাহিনীর জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে আছেন বলে দাবি করেছেন, তার চুক্তিতে বলা হয়েছে, "প্রশিক্ষণের সময়কাল পার হওয়ার পরে তাকে প্রতি মাসে এক লাখ ৯৫ হাজার রুবল বেতন দেওয়া হবে।’
‘এই বেতনের মূল্য তিন লাখ নেপালি রুপির বেশি। এক বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার পরে, সৈন্যরা রাশিয়ান পাসপোর্ট পাবেন এবং তারা তাদের পরিবারের সদস্যদেরও রাশিয়ায় আনতে পারবেন,’ রাজ বলেন।
সূত্র : বিবিসি
এসএমডব্লিউ