ভারতে সংসদ ভবন উদ্বোধনে নেই রাষ্ট্রপতি, বয়কট ১৯ বিরোধী দলের
আসছে ২৮ মে ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন করবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঘটনাচক্রে ওই দিনই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবর্তক এবং আরএসএস যাকে মতাদর্শগত গুরু বলে মান্য করে, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিন।
নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটি ভারতের ১৯টি বিরোধী দল একযোগে বয়কট করতে চলেছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি,নিউজ এইটিনসহ একাধিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। দেশটির বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস ছাড়াও বয়কটের ঘোষণা দেওয়া দলগুলোর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারে আসীন তৃণমূল কংগ্রেস, তামিলনাডু রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন ডিএমকে, বিহারের রাজ্যসরকারে ক্ষমতাসীন জোটের দুই সদস্য দল – জনতা দল ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল, কেরালা রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন সিপিএম এবং উত্তরপ্রদেশের প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শারদ পাওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপিও নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন বয়কট করবে বলে দলের এক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই।
প্রথম বয়কটের ঘোষণা তৃণমূল কংগ্রেসের
মঙ্গলবার রাতে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি ডেরেক ও’ব্রায়েন একটি টুইটে প্রথম এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কটের ঘোষণা দেন। টুইটবার্তায় তিনি বলেন, ‘পার্লামেন্ট কেবল একটি নতুন ভবন নয়। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতিষ্ঠিত প্রথা, মূল্যবোধ এবং নিয়ম আছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি এই পার্লামেন্ট। প্রধানমন্ত্রী মোদি সেটা মানেন না। তার কাছে নতুন ভবনের উদ্বোধন শুধুই আমি। তাই (উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে) আমাদের হিসাবে ধরবেন না।’
ডেরেকের এই টুইটের পরেই আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা সঞ্জয় সিং টুইট করেন যে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে সংসদ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানো তার প্রতি চরম অপমান। সেই সঙ্গে ভারতের দলিত, আদিবাসী সমাজের অপমান। এই অপমানের প্রতিবাদে এএপিও দলগতভাবে এই অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘মোদিজী মহামহিম রাষ্ট্রপতিকে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানোর প্রতিবাদে আম আদমি পার্টি উদ্বোধন অনুষ্ঠান বয়কট করছে,’ টুইটে লিখেছেন সঞ্জয় সিং।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বদলে প্রধানমন্ত্রী কেন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করবেন, তা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই সরব কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এক টুইটবার্তায় করে লিখেছেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি যখন অধিবেশন ডাকেন, একমাত্র তখনই সংসদ বসতে পারে। রাষ্ট্রপতিই যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়ে বার্ষিক সংসদীয় কার্যক্রম শুরু করেন। তার ভাষণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েই প্রতিবছর সংসদের কাজ শুরু হয়।’
‘নরেন্দ্র মোদি নতুন সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রপতিকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তাই। এটা অগ্রহণযোগ্য,’ টুইটবার্তায় বলেন ভারতের অন্যতম শীর্ষ এই নেতা।
তার কথায়, সংবিধানের ৭৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী সংসদের দুটি কক্ষ – উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভা এবং রাষ্ট্রপতি এই তিনের সমষ্টিই হলো ভারতের পার্লামেন্ট। তাই নতুন ভবন উদ্বোধন করা উচিত ছিল রাষ্ট্রপতিরই
কী বলছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা?
সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিজয় হানসারিয়া অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘এ নিয়ে বিতর্কের কিছু দেখছি না আমি। আমার এটাও মনে হয় না যে সংসদ ভবন উদ্বোধন রাষ্ট্রপতি না করে প্রধানমন্ত্রী করছেন বলে রাষ্ট্রপতিকে অসম্মান করা হচ্ছে।’
‘সংবিধানের ৭৯ নম্বর ধারায় লেখা আছে ঠিকই যে রাষ্ট্রপতি এবং দুটি কক্ষ – এই তিনে মিলেই সংসদ, কিন্তু এটাও সত্য যে প্রধানমন্ত্রী হলেন লোকসভার নেতা। সংসদীয় কাজে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হচ্ছে যে তার মাধ্যমেই যাবতীয় বিল পাশ হয়ে আইন তৈরি হবে। আর তার ভাষণ দিয়ে যে বছরের যাবতীয় সংসদীয় কাজ শুরু হয়, সেটা তো একটা প্রথা,’ বলছিলেন মি. হান্সারিয়া।
‘ইন্দিরা গান্ধীও তো সংসদের অ্যানেক্স উদ্বোধন করেছেন’
এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভানেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উদাহারণ টেনেছেন বিজেপি নেতারা। তারা বলছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদের ‘অ্যানেক্স’ভবন এবং রাজীব গান্ধী সংসদের গ্রন্থাগার ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন, সেক্ষেত্রে কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে?
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালের অগাস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদের অ্যানেক্স ভবনের, তারপরে ১৯৮৭ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সংসদের গ্রন্থাগারের উদ্বোধন করেছিলেন। কংগ্রেসের সরকার প্রধানেরা যদি সেগুলো উদ্বোধন করে থাকতে পারেন, তাহলে আমাদের সরকার প্রধান কেন একই কাজ করতে পারবেন না?’
কংগ্রেস এর জবাবও দিয়েছে এই বলে যে ‘অ্যানেক্স’ ভবনে পার্লামেন্টের কর্মকর্তা -কর্মচারীরা কাজ করেন আর গ্রন্থাগার – এই দুটিকে সংসদের অধিবেশন কক্ষের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। অ্যানেক্স এবং গ্রন্থাগারের থেকে সংসদীয় মর্যাদায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যসভা এবং লোকসভার অধিবেশন কক্ষ দুটি।
বিরোধী ঐক্যের প্রকাশ?
আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনকে লক্ষ্য করে বিজেপি বিরোধী দলগুলি ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জন্য আলোচনা করছে। বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে জোট বাঁধার প্রচেষ্টায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা চালাচ্ছেন। তিনি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, রাহুল গান্ধীদের সঙ্গে যেমন নিয়মিত বৈঠক করছেন, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদবের সঙ্গেও কথা বলেছেন।
প্রাথমিক ভাবে ওই প্রস্তাবিত বিরোধী জোটের নেতৃত্বে কংগ্রেসকে রাখা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির শীর্ষনেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরোধিতা থাকলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন কর্নাটকে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পরে ওই দুজনই কংগ্রেস সম্বন্ধে সুর নরম করেছেন।
অ-বিজেপি দলগুলির শীর্ষ নেতৃত্ব সম্প্রতি কর্নাটকে কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও এক জায়গায় হয়েছিলেন।
আবার দিল্লি সরকারের কাছ থেকে সরকারি কর্মচারীদের বদলি বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যে অধ্যাদেশ জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, সেটি রাজ্যসভায় যেন বিজেপি পাশ না করাতে পারে—সে জন্য বিরোধী দলগুলির কাছে আবেদন জানিয়ে বৈঠক করছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
মঙ্গলবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, বুধবার তিনি মুম্বাই গিয়ে প্রাক্তন মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ভব ঠাকরের সঙ্গে আর বৃহস্পতিবার এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
অ-বিজেপি দলগুলি যেভাবে একজোট হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন একযোগে বয়কট করা কি সেই প্রচেষ্টারই একটা প্রকাশ?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘বিরোধীরা এটাকে একটা ইস্যু করছে ঠিকই, খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চাইছে তারা বিষয়টিকে। কিন্তু এটা তো কোনও আন্দোলন নয়, যে তার মধ্যে দিয়ে সব বিরোধীরা একজোট হয়ে যাবেন, যেমনটা হয়েছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালে।’
‘দিল্লি অধ্যাদেশ নিয়ে অরভিন্দ কেজরিওয়াল সব বিরোধীদের নিয়ে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটাও কতটা সফল হবে, তা তো সংসদে ভোটাভুটি হলেই স্পষ্ট হবে। তাই নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন বয়কট করাটাকে বিরোধী ঐক্যের পথে একটা মাইলফলক, এরকমটা এখনও মনে হচ্ছে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএমডব্লিউ