ক্রেমলিনে ড্রোন হামলা কেন, নেপথ্যে কে?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারি বাসভবন ক্রেমলিনে ইউক্রেন দুটি ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মাধ্যমে ইউক্রেন পুতিনকে হত্যার চেষ্টা করেছে বলে মস্কো অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে মস্কো। অন্যদিকে, হোয়াইট হাউস মস্কোর অভিযোগকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
ক্রেমলিনের আকাশে উড়ে আসা দুটি ড্রোনই ভূপাতিত করে রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী। রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, পুতিন ওই সময় ক্রেমলিনের ভেতরে তার বাসভবনে ছিলেন না। বৃহস্পতিবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, এ হামলার পরিকল্পনা করেছে ওয়াশিংটন এবং ইউক্রেন তা বাস্তবায়ন করেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেনও এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, আক্রমণের ঘটনাটি রাশিয়ার সাজানো। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, তার দেশ এ রকম কোনও হামলা চালায়নি।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বলেছেন, রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে যেসব ড্রোন ওড়ানো হচ্ছে তা ‘স্থানীয় প্রতিরোধ-যোদ্ধাদের গেরিলা কর্মকাণ্ড।’
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া এ আক্রমণকে ‘প্রেসিডেন্টকে হত্যার জন্য চালানো সন্ত্রাসী হামলা’ বলে যে দাবি করছে– তাকে তারা অত্যন্ত সাবধানতার সাথে বিবেচনা করছে। রুশ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
গত রাতে কিয়েভ, জাপোরিঝিয়া ও ওডেসাসহ বেশ কয়েকটি ইউক্রেনীয় শহরে হামলা ও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।
• ক্রেমলিনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যর্থ?
লন্ডনভিত্তিক রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাইকেল ক্লার্ক বলছেন, কিয়েভ যদি এ আক্রমণ চালিয়ে থাকে তাহলে তা হবে ‘চরম বিস্ময়কর’ এবং ‘মস্তবড় বোকামি— যাতে এ যুদ্ধে তাদের পরাজয়ই ত্বরান্বিত হবে।’
কারণ রাশিয়ার ভেতরে এ ধরনের আক্রমণ চালালে ইউক্রেন ‘পশ্চিমা সমর্থন হারাবে এবং পশ্চিমা সমর্থন হারালে এ যুদ্ধেও তারা হারবে’, বলেন তিনি।
অধ্যাপক ক্লার্ক বলছেন, এটা অন্যের ওপর দোষ চাপানোর জন্য ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ আক্রমণ হতে পারে বা কোনও ‘ফ্রিল্যান্স’ যোদ্ধাও এটা করে থাকতে পারে।
বিবিসির বিশ্লেষক উইল ভারনন মস্কো থেকে জানাচ্ছেন, এ ড্রোন যদি সত্যিই পুতিনকে লক্ষ্য করে চালানো হয়ে থাকে, তাহলে এটা ক্রেমলিনের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। এবং বলতে হবে যে তাদের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এ ঘটনার পর মস্কো কী জবাব দেয় এবং কীভাবে দেয়, সেটাই প্রশ্ন।
মার্কিন সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সিআইএ কর্মকর্তা মিক মালরয় বলছেন, এটা হত্যাপ্রচেষ্টা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ ইউক্রেন পুতিনের গতিবিধির ওপর গভীরভাবে নজর রাখে এবং তিনি সেসময় মস্কোয় ছিলেন না।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়া হয়তো প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য এটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যে চেষ্টা তারা আগেও করেছে।
• ড্রোন হামলা কী নতুন?
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, বুধবার রাতে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে দু’টি তেল শোধনাগার লক্ষ্য করেও ড্রোন হামলা হয়। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়েছে।
এছাড়া সম্প্রতি রাশিয়ার ভেতরে এবং ইউক্রেনের রাশিয়া-অধিকৃত এলাকাতেও কিছু সন্দেহজনক ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ৪০০ কিলোমিটার ভেতরে কিরেইয়েভস্ক শহরে একটি ড্রোন গুলি করে নামানোর পর বিস্ফোরণে কমপক্ষে তিনজন আহত হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে মস্কোর ১০০ কিলোমিটার দূরে গুবাস্তোভো নামের এক গ্রামে একটি ড্রোন বিধ্বস্ত হয়। স্থানীয় গভর্নর বলেন, এটা ছিল বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলা চালানোর চেষ্টা। ভেঙে পড়া ড্রোনটি দেখে মনে হয়, এটা ছিল ইউজে টুয়েন্টি-টু জাতীয় একটি ড্রোন; যা ইউক্রেনে উৎপাদিত হয়। যা ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে ইউক্রেন সীমান্তের ৬০০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে একটি বিমানঘাঁটিতে এক ড্রোন হামলার কথা জানায় রুশ সামরিক বাহিনী; যাতে তিনজন নিহত হয়। এসব আক্রমণের কোনটিরই দায়দায়িত্ব ইউক্রেন সরকারিভাবে দাবি করেনি।
তবে কিয়েভের সামরিক বাহিনী বলেছে, তাদের পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতির একটি অংশ হচ্ছে রাশিয়ার সরঞ্জাম আনা-নেয়ার ক্ষমতা খর্ব করা। রুশ মিডিয়ার খবর বিশ্লেষণ করে বিবিসি দেখেছে, ২০২৩ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়া ও রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের ভেতরে ২০টিরও বেশি ড্রোন হামলার ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হয়।
আক্রমণগুলো ঘটেছে বিশেষ করে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক এবং বেলগোরদ আর রুশনিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়া ও তার রাজধানী সেভাস্তপোলে। এগুলোর লক্ষ্য ছিল তেল স্থাপনা, বিমান ঘাঁটি এবং রেল লাইন।
• পুতিনের বাসভবনে আছড়ে পড়া ড্রোনও কী ইউক্রেনের?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত দু’পক্ষই বিভিন্ন সময় ড্রোন ব্যবহার করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন থেকে নিক্ষিপ্ত ড্রোনগুলো সীমান্ত থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরের মস্কোসহ রাশিয়ার ভূখণ্ডের অনেকটা ভেতর পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম।
এভিয়েশনিস্ট ব্লগের সম্পাদক ডেভিড চেনচিওত্তি বলেন, ‘যদিও ইউক্রেন এটা নিশ্চিত করেনি যে, তাদের সেনাবাহিনীই এসব হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি গত বছরের আক্রমণগুলো থেকে বোঝা যায়, ইউক্রেনের সক্ষমতা আছে তাদের ভূখণ্ডের ভেতর থেকেই দূরপাল্লার আক্রমণ চালানোর।’
ড্রোন বিশেষজ্ঞ স্টিভ রাইটও বলছেন, ইউক্রেনের ভেতর থেকে ছাড়া ড্রোনের পক্ষে ক্রেমলিনে আঘাত করা সম্ভব। তবে তিনি বলছেন, তার ধারণা যে ক্রেমলিনের ওপর ধ্বংস করা ড্রোনটি হয়তো আরো কাছের কোনও জায়গা থেকে ছাড়া হয়েছিল। কারণ তাহলে সেটার পক্ষে মস্কোর প্রতিরক্ষা ব্যূহকে এড়ানো সম্ভব হবে।
ইউক্রেনের ডিজিটাল বিষয়ক মন্ত্রী মিখাইলো ফেদরভ সম্প্রতি বড়াই করে বলেন, ইউক্রেনের আর-১৮ নামে এমন এক ড্রোন আছে যা কিয়েভ থেকে মস্কো গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে। তবে তিনি বলেন, তিনি মস্কোর ওপর ড্রোন হামলা চালানোর আহ্বান জানাচ্ছেন না।
চেনচিওত্তি বলেন, ইউক্রেন তুরস্কের বিক্রি করা বায়রাক্টার টিবি-টু ড্রোনসহ বেশ কিছু ড্রোন এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। যাতে রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং অনলাইনে প্রচারিত ভিডিওতেও তা দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে বায়রাক্টার ড্রোন বিক্রি করেছে, তা ছাড়া এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি কিছু ড্রোন দানও করেছে। ইউক্রেনও বলেছে, তারা ড্রোন উৎপাদন দ্রুতগতিতে বাড়াচ্ছে কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে এর চাহিদা বাড়ছে। বিবিসি বাংলা।
এসএস