যেসব কারণে করোনা সুনামির মুখে চীন
চলতি ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সরকার ‘জিরো কোভিড’ নীতি থেকে সরে আসার পর চীনে করোনার দৈনিক সংক্রমণে যে উল্লম্ফন শুরু হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে সুনামিতে রূপ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, করোনাভাইরাসের নতুন কোনো ধরনের প্রভাবেই এই পরিস্থিতির মুখে পড়েছে দেশটি।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সঠিক হয়, সেক্ষেত্রে এক বছরেরও বেশি সময় পর এই ভাইরাসের নতুন একটি ধরন মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে; কিন্তু সত্যিই কোনো নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছে কিনা— সে সংক্রান্ত পরীক্ষা শুরুর ব্যাপারটিও এখন অনেকটা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো একটি ব্যাপার।
কারণ এক্ষেত্রে দৈনিক আক্রান্ত প্রতিটি রোগীর নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সের কাজ করতে হবে। চীনে বর্তমানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন। তাদের সবার নমুনা পরীক্ষা করার মতো জনবল এই মুহূর্তে সরকারের নেই।
আবার অনেক প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে করোনা টেস্টের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় সেখানকার তথ্যও জানা যাচ্ছে না।
করোনা মহামারি ইস্যুতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে চীনের অবস্থান স্বতন্ত্র। ২০২০ সালে করোনা মহামরি শুরুর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার একাধিক ঢেউ সহ্য করেছে, আবার সাধ্যমত গণটিকাদান কর্মসূচিও পরিচালনা করেছে। এসব কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক এমআরএনএ প্রযুক্তির লাখ লাখ ডোজ টিকা।
অন্যদিকে চীন করোনার দৈনিক সংক্রমণ ঠেকাতে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন প্রভৃতি কঠোর করোনাবিধি জারি রাখার ক্ষেত্রে যতখানি জোর দিয়েছে, সেই তুলনায় টিকাদান কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিয়েছে কম।
দেশটির গণটিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়েছে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত করোনা টিকা, যেগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা এমআরএনএ টিকার চেয়ে নিম্ন।
জনগণের নিম্ন শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের আবির্ভাবের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে— উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন গেইসেল স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক এবং ইনফেকশান ডিজিজ সোসাইটি অব আমেরিকার ফেলো ড্যানিয়েল লুসেই মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘সামনের দিন, সপ্তাহ ও মাসগুলোতে চীনে করোনার ওমিক্রন গোষ্ঠীর একাধিক ভাইরাসের আবির্ভাব যে ঘটবে— তা পুরোপুরি নিশ্চিত। এই মুহূর্তে চীনের সরকারের যা করা উচিত— তা হলো বর্তমানে দৈনিক আক্রান্ত করোনা রোগীদের প্রত্যেকের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বের করা। তাহলেই জানা যাবে— ইতোমধ্যে নতুন কোনো ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছে কিনা।’
ড্যানিয়েল লুসেই বলেন, ‘২০২০ সালের শেষ দিকে ভারতে যখন করোনার ডেল্টা ধরনের আবির্ভাব ঘটল— খুব শিগগিরই সেটি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল; কিন্তু বিভিন্ন দেশের প্রতিরোধী তৎপরতার কারণে এক পর্যায়ে আমরা সেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি।’
‘চীনের বর্তমান করোনার ঢেউ প্রতিরোধ করতে হলে অবিলম্বে জিনোম সিকোয়েন্সিং কর্মসূচি শুরু করা উচিত দেশটির সরকারের।’
তবে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত কিরবি ইনস্টিটিউটের ভাইরাসবিদ স্টুয়ার্ট টারভিল্লে অবশ্য ‘নতুন ধরনের আবির্ভাব’ তত্ত্বে পুরোপুরি বিশ্বাসী নন। ব্লুমবার্গকে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চীনের বর্তমান অবস্থা জন্য করোনার সম্ভাব্য নতুন কোনো ধরন দায়ী হতেই পারে, তবে আমার মনে হয়— গত আড়াই বছরে দেশটি যেভাবে মহামারি মোকাবিলা করেছে, সেখান থেকে হঠাৎ সরে যাওয়ই দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।’
‘কারণ, ইতোমধ্যে আমরা জানি করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনটি মূল করোনাভাইরাস বা এটির অন্যান্য সব ধরনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সংক্রামক।’
টারভেল্লির এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ভাইরাসবিদ অ্যালেক্স সিগালও। দেশটির ডারবান শহরের আফ্রিকা হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এই কর্মকর্থা বলেন, ‘চীনের পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের মতো নয়। করোনা প্রতিরোধে যে পরিমাণ শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা প্রয়োজন, তা দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত। কেবল নতুন ভাইরাসের আগমন ঘটলেই সংক্রমণে উল্লম্ফন হয়— এমন ধারণা সঠিক নয়।’
চীন অবশ্য নতুন ধরনের আগমনের সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখছে না। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ভাইরাল ডিজিজ কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক জু ওয়েনবো মঙ্গলবার বেইজিংয়ে এক সংবাদসম্মেলনে জানিয়েছেন, ওমিক্রনের যতগুলো উপধরনের জিনোম সিকোয়েন্স চীনের পরীক্ষাগারে আছে, নতুন আক্রান্ত রোগীদের নমুনা সেইসব সিকোয়েন্সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
‘বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি আমাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে আছে এবং ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি,’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন জু ওয়েনবো।
এসএমডব্লিউ