বিশ্বকাপ হচ্ছে ‘আমাদের শ্রমে-ঘামে’ : কাতারের অভিবাসী শ্রমিকরা
কাতার বিশ্বকাপের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসেছে। যাদের শ্রম-ঘামে নির্মিত বিভিন্ন স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচগুলোর আয়োজন হচ্ছে মরুভূমির এই দেশটিতে, সেই অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বিনা খরচে ম্যাচ উপভোগের ব্যবস্থা করেছে কাতারের সরকার।
জীবিকার তাগিদে বিশ্বের দরিদ্র ও নিম্নমধ্যম আয়ের বিভিন্ন দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের এই জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশটিতে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য প্রতিটি স্টেডিয়ামে পৃথক গ্যালারির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সেই গ্যালারির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পেশাল ফ্যান জোন’।
রোববার দোহা স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় ইকুয়েডর ও স্বাগতিক দেশ কাতারের মধ্যে। স্টেডিয়ামের স্পেশাল ফ্যান জোনে বসে এই দিন ম্যাচটি উপভোগ করেছেন হাজারেরও বেশি শ্রমিক।
ম্যাচ শুরুর বেশ আগেই স্টেডিয়ামে পৌঁছে যান তারা। কেউ নিজেদের মোবাইল দিয়ে সেলফি তোলেন, কেউ বা সবুজ ঘাসের মাঠে পা ছড়িয়ে বসেন।
২৫ বছরের বয়স্ক অভিবাসী শ্রমিক রোনাল্ড সিনয়োন্দো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ দেখতে এসেছেন দোহা স্টেডিয়ামে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই এখানে আমাদের শ্রম-ঘামকে উপভোগ করতে এসেছি।’
জীবিকার সন্ধানে আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ উগান্ডা থেকে দু’ বছর আগে কাতারে আসেন রোনাল্ড। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে আসার পর থেকে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
রোনাল্ড জানান, তিনি এবং তার মতো অন্যান্য অভিবাসী শ্রমিকরা মরুভূমির তীব্র রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছেন কাতারের এক একটি স্টেডিয়াম।
‘আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, বোঝাতে পারব না,’ রয়টার্সকে বলেন রোনাল্ড।
কাতারের মোট জনসংখ্যা ২৯ লাখ এবং এই জনসমষ্টির মধ্যে বর্তমানে দেশটির আদি বাসিন্দাদের চেয়ে অভিবাসী লোকজনের সংখ্যা বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের জ্বলানিসমৃদ্ধ এই ধনী দেশটিতে এখন নির্মাণ-আবাসন-গৃহকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহী পদেও রয়েছেন অভিবাসীরা।
বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, কাতারের সরকার অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো, বেতন বকেয়া রাখা ও তাদেরকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করার অভিযোগও রয়েছে দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে।
অবশ্য কাতারের সরকারের দাবি, দেশটির নতুন শ্রম আইনে ন্যূনতম মজুরি হিসেবে প্রতি মাসে ১ হাজার কাতারি রিয়াল (২৭৫ ডলার- ২৮ হাজার ৪৬০ টাকা) ধার্য করা হয়েছে এবং দেশের সর্বত্র এই আইন মেনে চলা হয়।
অভিবাসীরা যেন নিজেদের থাকা খাওয়ার খরচ মিটিয়ে দেশে কিছু টাকা পাঠাতে পারে, সেই বিবেচনাকে গুরুত্ব দিয়েই নতুন এই বেতনকাঠামো চালু করা হয়েছে বলে সরকারের ভাষ্য।
কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রতিটি ম্যাচের টিকেটের মূল্য ২০০ ডলার। তবে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত স্পেশাল ফ্যান জোনে বসে খেলা উপভোগ করতে আসা লোকজনদের কাছ থেকে টিকেটবাবদ কোনো অর্থ রাখা হচ্ছে না। বিনা খরচেই তারা ম্যাচ উপভোগ করতে পারছেন।
অবশ্য কোনো শ্রমিক যদি চান, সেক্ষেত্রে তিনি টিকেট কেটেও খেলা উপভোগ করতে পারবেন।
পাঁচ বছর ধরে কাতারে কাজ করা আলি জামাল (২৬) বলেন, ‘ইথিওপিয়ায় আমার বোন ও ভাইদের টাকা পাঠাচ্ছি আমি। টিকেটের দাম অনেক হওয়ায় এখানে এসেছি।’
এই জোনে উপস্থিত অল্প কয়েকজন নারীর একজন, এক নেপালি সেবিকা জানান, হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে বিশ্বকাপের আর কোনো ম্যাচ দেখতে পারবেন না তিনি।
চলতি বছরের প্রথমদিক থেকে কাতারে কাজ করতে থাকা ভারতীয় মোহাম্মদ আনসার (২৮) জানান, বিশ্বকাপের দুটি ম্যাচে ভলান্টিয়ার হিসেবে দায়িত্বপালন করবেন তিনি, তাই সেগুলো স্টেডিয়ামের ভেতর থেকে সরাসরি দেখতে পাবেন।
ইকুয়েডরের কাছে ২-০ গোলে কাতারের হারে হতাশ হলেও রোববার সহকর্মীদের সঙ্গে ম্যাচটি দেখতে পেরে খুশি তিনি; রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘তারা গরিবদের কথাও বিবেচনা করেছে, এখানে বিনা খরচে খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’
এসএমডব্লিউ