সেনাবাহিনী নিয়ে প্রেসিডেন্টকে ইমরানের চিঠি, ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে?
পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রভাব অনেক বেশি। নিজস্ব সামরিক নানা ইস্যুর বাইরেও রাজনীতিতে প্রায়ই হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠে থাকে তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া পিটিআই সরকার ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং দেশটির সেনাবাহিনীর এক অংশ এখন কার্যত মুখোমুখি বলে প্রায়ই শোনা যায়।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভির কাছে নজিরবিহীন এক চিঠি লিখেছেন ইমরান খান। সেখানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সীমা-পরিসীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ইমরানের এই চিঠির পর এবার পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে, নাকি বর্তমান পরিস্থিতিই অব্যাহত থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ইমরানের চিঠির পর প্রেসিডেন্ট আলভি এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এবং দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশরনাল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরল এক পদক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর)-এর কর্মকাণ্ডের সীমা-পরিসীমা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে এবং শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত তথ্য প্রচারের মধ্যে তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রাখতে প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভিকে চিঠি লিখেছেন পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান।
প্রেসিডেন্টকে লেখা চিঠিতে ইমরান খান বলেছেন, ‘আইএসপিআর-এর মতো একটি সামরিক তথ্য সংস্থার কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি প্রতিরক্ষা ও সামরিক ইস্যু সম্পর্কিত তথ্যের মধ্যেই স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত এবং সীমাবদ্ধ হওয়া দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে আমি আপনাকে আইএসপিআর-এর জন্য স্পষ্ট অপারেশনাল লাইন তৈরি করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি প্রেসিডেন্ট আলভিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, সেনাপ্রধান এবং প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর মহাপরিচালকের মধ্যে গোপনীয় কথোপকথনের কথিত অডিও ফাঁসের তদন্ত করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে সাম্প্রতিক সাইফার ইস্যুও তদন্তের দাবি করেন ইমরান।
গত ৬ নভেম্বর তারিখে লেখা ইমরান খানের এই চিঠির একটি অনুলিপি সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের কাছে রয়েছে। এতে চলতি বছরের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে পিটিআই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে এবং পরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বিশদ বিবরণ দেওয়া রয়েছে।
ইমরান অভিযোগ করেন, তার দল মিথ্যা অভিযোগ, হয়রানি, গ্রেপ্তার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান মাত্রার মুখোমুখি হয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক এই প্রথানমন্ত্রী চিঠিতে আরও অভিযোগ করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (রানা সানাউল্লাহ) তাকে বারবার হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এবং একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা যে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন; সেকথা তাকে (আগেই) জানানো হয়েছিল বলেও জানান ইমরান। গত সপ্তাহে পিটিআই লংমার্চের সময় চক্রান্তটি কার্যকর করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছেন এবং হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
ইমরান বলেছেন, ‘আজকে প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন শুধু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নয়, বরং আমাদের সংবিধানের ২৪৩ (২) অনুচ্ছেদের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবেও পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করে এমন গুরুতর অন্যায়গুলোকে আমলে নেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। একইসঙ্গে দোষীদের শনাক্ত করতে এবং তাদের জবাবদিহি করতে আপনার নেতৃত্বে একটি তদন্ত শুরু করুন।’
সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন বলছে, ইমরান খান যখন সংসদীয় অনাস্থা ভোটের পরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন এবং চলতি বছরের এপ্রিলে শেহবাজ শরিফ নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন তখন ব্যক্তি হিসাবে প্রেসিডেন্ট আলভি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং নিজ দলের প্রতি আনুগত্যের মধ্যে কার্যত আটকা পড়েছিলেন।
কারণ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে আরিফ আলভি ছিলেন পিটিআই-এর সিনিয়র নেতাদের একজন এবং ক্ষমতায় আসার আগে ইমরানের সংগ্রামবহুল বছরগুলোতে ছায়ার মতো সাবেক এই তারকা ক্রিকেটারের পাশে ছিলেন।
তবে ইমরান ক্ষমতা হারানোর পর হঠাৎ করেই তাকে এমন একজন প্রধানমন্ত্রীকে মোকাবিলা করতে হয়, যাকে তার নেতা (ইমরান) বিশ্বাস করেন, বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তাই শেহবাজ শরিফের জোট সরকারকে সহযোগিতা না করার জন্য প্রেসিডেন্ট আলভির ওপর (দলীয়) চাপ ছিল।
শুরুতে আরিফ আলভি ইমরানের পথই অনুসরণ করেন এবং নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন। কিন্তু পরে বাস্তবতা মেনে নিয়ে পিটিআই অনুগত কর্মীর পরিবর্তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্বপালনের চেষ্টা করেন আলভি।
এরপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট বাড়লে প্রেসিডেন্ট আলভি বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আসছেন এবং সেনাপ্রধান ও পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অন্তত দু’টি বৈঠকের আয়োজন করেছেন।
তবে অনেকে বিশ্বাস করেন, পিটিআই প্রধান ইমরান খান প্রেসিডেন্ট আলভির ওপর সন্তুষ্ট নন। বিশেষ করে লংমার্চে হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়ার পরে। কারণ হামলার শিকার হওয়ার পর প্রেসিডেন্টের কাছে (নিজের পক্ষে) স্পষ্ট অবস্থান চেয়েছিলেন ইমরান।
আর এরই ধারাবাহিকতায় লেখা ওই চিঠিতে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভিকে ‘এখনই কাজ’ করার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে ইমরানের পিটিআই।
ইমরান বলেছেন, তিনি এবং প্রেসিডেন্ট (আলভি) পাকিস্তানের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং আলভিকে অবশ্যই ‘দেশের গণতন্ত্র এবং সংবিধান রক্ষা করতে হবে’। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দেশের আইনের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।
উপসংহারে ইমরান বলেন, ‘আপনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত এবং আমি আপনাকে এখনই ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আমাদের আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে।’
এদিকে ইমরানের এই চিঠির পর সবার আগ্রহের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি। প্রশ্ন উঠেছে, ইমরানের এই নজিরবিহীন চিঠির পর সংকট কাটাতে আলভি কী আসলেই কোনো পদক্ষেপ নেবেন।
অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদটি অনেকটা সাংবিধানিক এবং ক্ষমতা কাঠামোয় আলঙ্কারিক। আর তাই ইমরানের চিঠি সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট আলভির কোনো আইনি বা সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি (পিলডাট)-এর নির্বাহী পরিচালক আহমেদ বিলাল মেহবুদ মন্তব্য করেছেন, ‘ইমরানের চিঠিটি পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি সর্বোচ্চ যে কাজটি করতে পারেন, তা হলো- চিঠিটি তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তরে পাঠাতে পারেন।’
প্রেসিডেন্ট সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হতে পারেন কিন্তু বাস্তবে তার কোনও নির্বাহী ক্ষমতা নেই এবং তিনি কেবল প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করতে পারেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি তার সাংবিধানিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চান, তাহলে কী হবে?
আহমেদ বিলাল মেহবুদ বলছেন, ‘কিন্তু (সাংবিধানিক ক্ষমতার বাইরে যেতে চাইলে) তিনি কেবল একটি উপদ্রব তৈরি করতে পারেন। আর তেমন কিছু হলে তা প্রেসিডেন্টের একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে।’
টিএম