বৈশ্বিক চালের ‘নাটাই’ কেন ভারতের হাতে?
গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার ভারতের আকস্মিক সিদ্ধান্ত চাল রপ্তানিতে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি করেছে। যে কারণে ব্যবসায়ীরা তড়িঘড়ি করে চাল কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন এবং অনেক পরের তারিখেও সরবরাহ পাওয়ার জন্য চালের অর্ডার করছেন।
ভারতের সরকার ও বাণিজ্য কর্মকর্তারা বলেছে, বিশ্বের বৃহত্তম চালের রপ্তানিকারক ভারতের আপাতত চালানের লাগাম টানার কোনও পরিকল্পনা নেই। স্থানীয় বাজারে চালের দাম এখনও কম এবং রাষ্ট্রীয় গুদামেও প্রচুর মজুত রয়েছে।
দেশটির এই ঘোষণা ইতোমধ্যে ক্রমবর্ধমান দামের সাথে ধুঁকতে থাকা আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তি তৈরি করেছে। কিন্তু ভারতের ধান উৎপাদনের মৌসুম শুরু হতে এখনও অনেক দেরী এবং ফসল উৎপাদনে কোনও ব্যত্যয় ঘটলে তা দেশটির প্রধান এই খাদ্য শস্য রপ্তানির নীতিতেও পরিবর্তন আনতে পারে।
ভারতে চালের উৎপাদন কেমন হবে তা অনেকটা মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে। চলতি বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় তা বিশ্বজুড়ে চাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করবে দেশটিকে।
তবে বর্ষাকালে যদি অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়, সেক্ষেত্রে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হবে এবং ফলন কমে যাবে। এর ফলে দেশটির চাল উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ব্যাহত হবে। একই সঙ্গে দেশের ১৪০ কোটি মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রপ্তানিতেও লাগাম টানতে হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে চাল সরবরাহে ভারত এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
গত বছর ভারতের চাল রপ্তানি রেকর্ড ২ কোটি ১৫ লাখ টন ছুঁয়েছে। ভারতের এই চাল রপ্তানি বিশ্বের বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক চার দেশ— থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট রপ্তানির চেয়েও বেশি।
বিশ্বে চীনের পর চালের প্রধান ভোক্তা দেশ ভারত। বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশেরও বেশি চালের মার্কেট শেয়ার রয়েছে ভারতের।
অভ্যন্তরীণ উচ্চ মজুত আর স্থানীয় বাজারে কম দামের কারণে গত দুই বছর ব্যাপক ছাড়ে চাল বিক্রি করেছে ভারত। যা এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশকে গমের দামের ঊর্ধ্বগতির সাথে লড়াই করতে সাহায্য করেছে।
বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে চাল রপ্তানি করে ভারত। দেশটির চালান হ্রাস পেলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। ২০০৭ সাল ভারত যখন চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে তখন বিশ্ববাজারে এর দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।
ভারত চাল রপ্তানিতে বিধি-নিষেধ আরোপ করলে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
ভারত রপ্তানি সীমিত করার যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক চাল আমদানিকারক দেশকে আঘাত করবে। এর ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী সরবরাহকারী থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামও দাম বৃদ্ধির সুযোগ পাবে; যা ইতোমধ্যে ভারতীয় চালানের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
চীন, নেপাল, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইনের মতো এশিয়ান ক্রেতা ছাড়াও টোগো, বেনিন, সেনেগাল এবং ক্যামেরুনের মতো দেশেও চাল সরবরাহ করে ভারত।
ভারতে বর্ষা মৌসুমের ভূমিকা কী?
ভারতের বার্ষিক চাল উৎপাদনের ৮৫ শতাংশের বেশি আসে গ্রীষ্মকালের রোপণ করা ধান থেকে, যা শস্য বছরের ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বেড়ে রেকর্ড ১২৯ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির কোটি কোটি কৃষক গ্রীষ্মকালীন ধান রোপণ শুরু করেন জুন মাসে। এরপরই ভারতে শুরু হয় বর্ষা মৌসুম। ভারতের
বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় বর্ষা মৌসুমে। ভালো ফলনের জন্য বৃষ্টির পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের অর্ধেক কৃষিজমিতে সেচের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ভারতীয় কৃষকরা বর্ষার বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করেন। চলতি বছর ভারতে গড় বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশটিতে চার মাসের বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও গত ১ জুন থেকে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের যে রেকর্ড করা হয়েছে, তা পূর্বাভাসের গড়ের চেয়ে ৪১ শতাংশ কম।
দেশটিতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত চলতি মাসের মাঝের দিকে হতে পারে বলে আশা হচ্ছে। সেই সময় ধানের বীজ বপনের পুরো মৌসুম শুরু হবে। গত তিন বছরের গড় বা তার বেশি বৃষ্টিপাত এবং নতুন ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির ফলে দেশটিতে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
চাল সরবরাহ নিয়ে ভারত সরকারের কী উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
ভারতে বর্তমানে পর্যাপ্ত পরিমাণ চালের মজুত রয়েছে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে যে দামে ধান কেনে, তার চেয়েও স্থানীয় বাজারে দাম কম।
দেশটির চালের রপ্তানি মূল্যও গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
এদিকে, সরকারের নির্ধারিত ১৩ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন টন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চারগুণ বেশি— ৫৭ দশমিক ৮২ মিলিয়ন টন চাল ও ধান সরকারি গুদামে মজুত রয়েছে।
কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল চালের প্রধান উৎপাদক বা ভোক্তা না হওয়ায় গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর গমের মতো চাল রপ্তানির বাড়তি আদেশ পায়নি ভারত।
সূত্র: রয়টার্স।
এসএস