যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে মহামারির মতো বাড়ছে বন্দুক হামলা
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের টেক্সাস রব এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুক হামলায় যেদিন ১৯ শিক্ষার্থী ২১ জন মারা গেল, সেদিন মঙ্গলবারই দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির একটি প্রাথমিক স্কুলেও ঘটেছিল পৃথক একটি হামলা; তাতে আহত হয় তিনজন শিক্ষার্থী।
তার আগের দিন সোমবার দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য পেনসিলভেনিয়ার বৃহত্তম শহর ফিলাডেলফিয়ার একটি হাইস্কুলে গোলাগুলির ঘটনায় আহত হয়েছিল তিন কিশোর। তারও আগে, গত সপ্তাহে মিশিগান, লুইজিয়ানা ও টেনেসি অঙ্গরাজ্যের তিন গ্র্যাজুয়েট স্কুলে ঘটেছিল বন্দুক হামলা।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কুলের সেন্টার ফর হোমল্যান্ড ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির কে-টুয়েলভ স্কুল শুটিং ডেটাবেইজের প্রধান গবেষক ডেভিড রিডম্যান এক সাক্ষাৎকারে রয়টার্সকে বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে মহামারির মতো বাড়ছে বন্দুক হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা। তার কাছে থাকা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২২ সালের ৫ মাসে প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো স্কুলে বন্দুক হামলা হয়েছে।
মঙ্গলবার টেক্সাস রব এলিমেন্টারি স্কুলে এক বন্দুকধারীর নির্বিচার গুলিতে নিহত হয় ১৯ জন শিক্ষার্থী ও ২ জন শিক্ষক। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্ব যখন বাকরুদ্ধ, সেসময় দেশটির বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন— যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বন্দুক হামলা ও গোলাগুলি প্রায় মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তবে অধিকাংশ ঘটনা ছোট পরিসরে ঘটায় তা সংখ্যক মানুষের নজরে আসছে না।
রয়টার্সকে রিডম্যন বলেন, সরকারি এক গবেষণায় জানা গেছে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে ১৩৭টি স্কুলে গোলাগুলি হয়েছে। হিসেবে দেখা যায়, ২০২২ সালে প্রায় প্রতিদিনই একটি করে হামলা হয়েছে দেশটির স্কুলগুলোতে। গত বছর ২০২১ সালে এই হামলার সংখ্যা ছিল ২৪৯টি।
স্কুলের এলাকার মধ্যে বন্দুক উঁচিয়ে আস্ফালন, গুলিবর্ষণ বা স্কুলের সম্পত্তিতে গুলি- এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা হিসাবে আনা হচ্ছে এ গবেষণায়।
‘সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, স্কুলগুলোতে পদ্ধতিগত বন্দুক সহিংসতা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে; বিশেষ করে হাইস্কুলগুলোতে। শিক্ষার্থীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় তাদের মধ্যকার সব দ্বন্দ্ব গোলাগুলির পর্যায়ে গিয়ে শেষ হচ্ছে,’ রয়টার্সকে বলেন রিডম্যান।
তিনি আরও জানান, টেক্সাসের রব এলিমেন্টারি স্কুলে হামলার আগ পর্যন্ত গত ৫ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যত বন্দুক হামলা হয়েছে, তাতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন, আহত হয়েছেন ৭৭ জন। নিহতদের মধ্যে ৭ জনই শিক্ষার্থী।
যুক্তরষ্ট্রে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে নির্বিচার গুলিবর্ষণ। তবে দেশটির স্কুলগুলোতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তিনটি বন্দুক হামলা ঘটেছে গত এক দশকের মধ্যে। বন্দুকসহিংসতা বিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভায়োলেন্স প্রজেক্টের সহ প্রতিষ্ঠাতা জেমস ডেন্সলি রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
নির্বিচার গুলিবর্ষণের যেসব ঘটনায় চার জন বা তারও বেশি মানুষ নিহত হয় সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রজেক্ট।
ডেন্সলির মতে, যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে প্রথম ভয়াবহ বন্দুক হামলাটি ঘটে ২০১২ সালে। ওই বছল স্যান্ডি হুক প্রাথমিক স্কুলে এক বন্দুকধারী ২৬ শিশু ও এক স্কুলকর্মীকে হত্যা তরে। তারপর ২০১৮ সালে ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ডে মার্জারি ডগলাস হাইস্কুলে গোলাগুলির ঘটনায় প্রাণ হারান ১৭ জন এব সর্বশেষটি হলো টেক্সাসে ঘটা হত্যাকাণ্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগামী শিশুদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার ঝুঁকি যেভাবে ছায়া ফেলে আছে, বিশ্বের অন্য অধিকাংশ দেশেই এমন দেখা যায় না। মার্কিন শিশুরা অল্প বয়স থেকেই নিয়মিত ‘অ্যাকটিভ শুটার ড্রিল’ অনুশীলন করে; এটি একপ্রকার আত্মরক্ষঅর কৌশল এবং এতে বন্দুকধারীর হামলা হলে শ্রেণিকক্ষের লাইট বন্ধ করে ও প্রবেশপথ আটকে দিয়ে কীভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে, তা শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়।
আগাম সতর্কতা হিসেবে অনেক স্কুলে প্রধান গেট বন্ধ করার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের দরজাও বন্ধ করে রাখা হয়। এভাবে সম্ভাব্য বন্দুকধারীদের ঠেকিয়ে রাখার আশা করে তারা। টেক্সাসে স্কুলগুলোর জন্য একটি মার্শাল কর্মসূচীও আছে, যার আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পিস্তল-রিভলবার জাতীয় হ্যান্ডগান বহন করার অনুমতি রয়েছে।
গোলাগুলির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্কুলের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে একটি শিল্পও গড়ে উঠেছে। বহু স্কুলে বুলেট-প্রুফ দরজা ও জানালা, বিশেষ তালা লাগানো হয়েছে; বসানো হয়েছে মেটাল ডিটেক্টর। কিছু স্কুল সশস্ত্র রক্ষী ভাড়া করে পাহারা জোরদার করেছে।
কিন্তু তারপরও এসব উদ্যোগ প্রায়ই স্কুল ক্যাম্পাসে বন্দুকের প্রবেশ ও প্রাণঘাতী হামলা ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ডেন্সলি।
সূত্র: রয়টার্স
এসএমডব্লিউ