মাঙ্কিপক্স কতটা প্রাণঘাতী?
• বিশ্বজুড়ে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের বিস্তারে নিবিড় দৃষ্টি রাখছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ
• শনিবার পর্যন্ত বিশ্বের ১২টি দেশে ৯২ জনের মাঙ্কিপক্স শনাক্ত
• সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে মার্কিন সিডিসির উদ্বেগ
করোনাভাইরাস মহামারি এখনো শেষ হয়নি। এরমধ্যেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আরেক সংক্রামক ভাইরাস মাঙ্কিপক্স। আক্রান্ত কিছু রোগীর জন্য এ ভাইরাস প্রাণঘাতীও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মাঙ্কিপক্সকে ‘শনাক্তযোগ্য ও বর্ধনশীল ব্যাধি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
এখন পর্যন্ত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের ১২টি দেশে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল হেলথের তথ্য বলছে, বিশ্বে ১১১ জন এই ভাইরাসে সংক্রমিত অথবা সন্দেহভাজন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।
যেসব দেশে শনাক্ত হয়েছে মাঙ্কিপক্স
১. অস্ট্রেলিয়া
২. বেলজিয়াম
৩. কানাডা
৪. ফ্রান্স
৫. জার্মানি
৬.পর্তুগাল
৭. স্পেন
৮. সুইডেন
৯. ইতালি
১০. নেদারল্যান্ডস
১১. যুক্তরাজ্য
১২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আক্রান্ত দেশ এবং অন্যান্যদের সাথে কাজ শুরু করেছে। মাঙ্কিপক্স শনাক্ত, নজরদারি এবং আক্রান্তদের চিকিৎসায় সহায়তা করছে বৈশ্বিক এই স্বাস্থ্য সংস্থা।
মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্স একটি বিরল ও স্বল্প পরিচিত রোগ। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। তারপর একসময় মানবদেহেও সংক্রমণ ঘটায় মাঙ্কিপক্স।
সাধারণত হালকা ভাইরাল সংক্রমণের জন্য দায়ী এই ভাইরাস। ভাইরাসটি গুটিবসন্তের মতো একই প্রজাতির সদস্য। এই প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস; যা গুটিবসন্তের কারণ, ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস (গুটিবসন্ত ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত) ও কাউপক্স ভাইরাস।
কত প্রজাতির মাঙ্কিপক্স রয়েছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের দু’টি প্রজাতির সন্ধান মিলেছে।
১. কঙ্গো প্রজাতি
২. মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি
মাঙ্কিপক্স কতটা প্রাণঘাতী?
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কঙ্গো প্রজাতির প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত গুরুতর। ওই অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের বেশি। আর এতে বাচ্চাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতির তীব্রতা তুলনামূলক কম। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের মতো।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১২টি দেশে শনাক্ত হওয়া মাঙ্কিপক্স আসলে কোন প্রজাতির তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। যদিও যুক্তরাজ্যে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
মহামারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ সাধারণত ‘একেবারে বিরল।’ যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সতর্ক করে বলেছে, পর্তুগাল ও স্পেনের প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এরিক ফেইগল-ডিং বলেছেন, ‘এটা একেবারে অস্বাভাবিক। তারপরও লোকজন বলছে, এটা ঠিক ফ্লুর মতো, এছাড়া কিছু নয়। আমরা কি নতুন তথ্য-উপাত্ত দেখে শিক্ষা নিচ্ছি?’
ইঁদুর ও কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীর মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে পারেন কীভাবে
ভাইরাসটি মানবদেহে বেশ কয়েকটি উপায়ে প্রবেশ করতে পারে।
• ভগ্ন ত্বক (যদিও তা দেখা যায় না)
• শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ
• সংক্রমিত প্রাণীর কামড়
• আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত, শরীরের তরল বা পশম স্পর্শ করা
• সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া হলে
• ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারো ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা অথবা তোয়ালে স্পর্শ করা
• মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোস্কা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ করা অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়া
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস কি বায়ুবাহিত?
অতীতের বেশ কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, মাঙ্কিপক্স বায়ুবাহিত এবং ৯০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসে টিকে থাকতে পারে। এর অর্থ এই সময়কালে (৩.৭৫ দিন) এটি সংক্রামকও হতে পারে।
২০১২ সালে ভাইরোলজিক্যাল মেথোড সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণার বরাত দিয়ে হার্ভার্ডের মহামারি বিশেষজ্ঞ এরিক ফেইগল-ডিং বলেন, মাঙ্কিপক্স সম্ভবত বায়ুবাহিত তরল অথবা কঠিন পদার্থের কণার মতো (অ্যারোসল)।
‘আমি কামনা করছি, করোনাভাইরাস যে বায়ুবাহিত আমরা সেটি থেকে শিক্ষা নিয়েছি এবং গত দুই বছরের জলীয় কণা বা ড্রপলেট বনাম বায়ুবাহিত’র মতো বাজে কথার পুনরাবৃত্তি করবেন না।’
মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে বিশেষ ওষুধ বা ভ্যাকসিন আছে কি?
এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ অথবা ভ্যাকসিন নেই। অতীতে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ রোধে গুটিবসন্তের টিকা ব্যবহার করা হয়েছিল। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন, সেই স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু করেছে যুক্তরাজ্য।
মার্কিন সরকার বলেছে, পুরো দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য স্ট্র্যাটেজিক ন্যাশনাল স্টকপাইলে (এসএনএস) গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের যথেষ্ট মজুত আছে। এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, গুটিবসন্তের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রয়েছে; যা বিশেষ পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতীতে কি এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল?
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। আমদানি করা প্রাণীর দেহ থেকে দেশটিতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই সময় দেশটির ছয়টি প্রদেশের ৭১ জনের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছিল।
গত ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়।
১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১ দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের পর নাইজেরিয়ায় এবার সবচেয়ে বেশি এ রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। দেশটিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের দেহে উপসর্গ দেখা গেছে এবং ১৫ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সংক্রমণের ধরন কি একই?
চারটি মহাদেশের লোকজন কীভাবে মাঙ্কিপক্সের সংস্পর্শে এসেছেন তা এখনো পরিষ্কার নয়। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কারও শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আইসোলেশনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
তবে বর্তমানে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হওয়া লোকজনের মাঝে— এমন অনেক পুরুষ আছেন, যারা পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করেছেন। স্পেনের মাদ্রিদ অঞ্চলের সাউনার কয়েকটি ঘটনায় এ ধরনের শারীরিক সম্পর্কের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
• মানবদেহে বিরল ‘মাঙ্কি পক্স’ ভাইরাসের সন্ধান, কী এই রোগ
এসএস