ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করল কেন?
ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় বিশ্ববাজারে এই খাদ্যশস্যের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার মাঝেই ভারতের রপ্তানি নিষিদ্ধের এই ‘সুরক্ষাবাদী’ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বের উন্নত সাত দেশের জোট জি৭ কড়া সমালোচনা করেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী ভারত বলেছে, ‘ব্যবসায়ীরা কেবল সরকারি অনুমোদন নিয়ে নতুন রপ্তানি চুক্তি করতে পারবে।’
গত ১৩ মে দেশটির সরকারি এক আদেশে বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানির জন্য ইতিমধ্যে যেসব ঋণপত্র ইস্যু হয়েছে এবং যেসব দেশ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য রপ্তানির অনুরোধ জানিয়েছে, সেই দেশগুলোতে এখনও গম রপ্তানির অনুমতি দেবে নয়াদিল্লি।
আগে ভারতের নীতি কী ছিল?
এর আগে, ভারত বলেছিল, গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে সৃষ্ট সরবরাহ ঘাটতির কিছুটা পূরণে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছে নয়াদিল্লি। বিশ্ববাজারে গমের মোট রপ্তানির প্রায় ১২ শতাংশ ভারতের।
দেশটির সরকার চলতি অর্থবছরে বিশ্ববাজারে গম রপ্তানি ৭০ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টন করার পরিকল্পনা করেছে। গত এপ্রিলে দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযুশ গয়াল বলেছিলেন, আমাদের কৃষকরা শুধু ভারত নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের গমের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রাখছেন।
গত সপ্তাহে ভারত জানায়, গম রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করতে মিসর, তুরস্ক এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিনিধি পাঠাবে নয়াদিল্লি। তবে এই সফর এখন হবে কি-না সেটি স্পষ্ট নয়।
গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা কেন?
১৪০ কোটি জনসংখ্যার দরিদ্র এই দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে গমের দাম বেড়েছে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তা কোনও কোনও এলাকায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে রোববার দেশটির বাণিজ্যসচিব বিভিআর সুব্রাহ্মনিয়াম জানিয়েছেন। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক দাম বৃদ্ধির কারণে দেশটির কিছু কৃষক সরকারের কাছে গম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। তারা ব্যবসায়ীদের কাছে এই খাদ্যশস্য বিক্রি করছে।
এর ফলে সম্ভাব্য যেকোনও দুর্ভিক্ষ এড়াতে এবং মহামারিতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লাখ লাখ পরিবারকে সহায়তার লক্ষ্যে ২ কোটি টন গম মজুতের পরিকল্পনা নিয়ে দেশটির সরকার চিন্তিত।
বিভিআর সুব্রাহ্মনিয়াম বলেছেন, গম অনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় রপ্তানি অথবা মজুত করা হোক আমরা সেটি চাই না। বরং ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা আছে, এমন দেশে সরকারের অনুমতি নিয়ে গমের রপ্তানি করা যাবে।
ভারতে দাবদাহ কেমন?
ভারতে চলতি বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে মার্চকে রেকর্ড করা হয়েছে। যা অনেকাংশে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে তাপদাহ ক্রমান্বয় বাড়ছে।
ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের (আইএমডি) বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, রোববার রাজধানী নয়াদিল্লিতে তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে।
দিল্লির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মুঙ্গেশপুর ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় শহরে তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৪৯ দশমিক ২ এবং ৪৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিল্লির বাসিন্দাদের প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তীব্র দাবদাহ দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর গমের উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। যে কারণে দেশটির সরকার ২০২১ সালের ১০৯ মিলিয়ন টনের তুলনায় চলতি বছরে গমের উৎপাদন কমপক্ষে ৫ শতাংশ কম হবে বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে।
প্রতিক্রিয়া কেমন?
জার্মানিতে এক বৈঠকে অংশ নিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জোট জি৭ এর কৃষিমন্ত্রীরা ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। জার্মানির খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী সেম ওজদেমির বলেছেন, ‘যদি প্রত্যেকে রপ্তানি বিধি-নিষেধ আরোপ করতে শুরু করে অথবা বাজার বন্ধ করে দেয়, তাহলে সঙ্কট আরও বাড়বে।’
সোমবার ইউরোপীয় বাজারে গমের দাম বৃদ্ধির নতুন রেকর্ড হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রতি টন গমের দাম বেড়ে ৪৩৫ ইউরোতে পৌঁছেছে।
ভারত কী গমের বড় রপ্তানিকারক?
উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম হলেও বৈশ্বিক গমের বাজারে ভারতের অবস্থান একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে। কারণ দেশটিতে উৎপাদিত গমের বেশিরভাগই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই ব্যবহৃত হয়। গত বছর দেশটির মোট গম রপ্তানির অর্ধেকেই গেছে প্রতিবেশি বাংলাদেশে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে রাশিয়া এবং ইউক্রেন ৫ কোটি ৩০ লাখ টন গম এবং মেসলিন (গম ও রাইয়ের মিশ্রণ) রপ্তানি করলেও ভারত এক কোটি টন রপ্তানির পূর্বাভাষ দিয়েছিল।
কিন্তু গুনগত মান নিয়ে উদ্বেগ এবং শস্য ক্রয় সম্পর্কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মের কারণে দেশটির রপ্তানি সীমিত করা হয়।
তাহলে প্রভাব এত বেশি কেন?
ইউক্রেন সংঘাতের পর সরবরাহ বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় বিশ্বব্যাপি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। যা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ এবং সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।
বিশ্বে ভারতের গম রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও রুশ-ইউক্রেন সঙ্কটের কারণে নিজের বিশাল মজুত থেকে রপ্তানির আশ্বাস দেওয়ায় বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
দেশটির বাণিজ্যসচিব বিভিআর সুব্রাহ্মনিয়াম বলেছেন, কোনও আদেশই স্থায়ী নয়। যদি বিশ্বব্যাপি সরবরাহ এবং চাহিদা একই থাকে এবং আবারও দাম বৃদ্ধি পায়, তাহলে আদেশ পুনর্বিবেচনা করা হবে।
সূত্র: এএফপি, এনডিটিভি।
এসএস