কৃষক আন্দোলন নিয়ে ভাবমূর্তি সংকটে মোদি
বিতর্কিত ৩ কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গত বছরের নভেম্বর থেকে ভারতের রাজধানী অঞ্চল দিল্লির সীমানায় শুরু হওয়া কৃষক আন্দোলনের স্থায়িত্ব যত বাড়ছে, একজন বিশ্বনেতা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিও ঠিক ততটাই ম্লান হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে; বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে।
রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস, লা মদঁ, টাইম, ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান, লন্ডন টাইমসসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো ভারতে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে নিজেদের সমালোচনামূলক অবস্থান স্পষ্ট করেছে; যেমনটা এর আগে দেখা যায়নি।
দিল্লির সীমানায় প্রায় তিন মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত যেভাবে দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তার কেমন প্রভাব পড়ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে?
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও জনমতের দিকে লক্ষ্য করলে এমন মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে বিজেপি শাসনামলে এর আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়, যেমন— বিরোধী দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে ভারতের পার্লামেন্টে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল, বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, গো-মাংস রাজনীতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রভৃতি অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে চলমান এই কৃষক আন্দোলনে বিজেপির আক্রমণাত্মক ভূমিকায়।
অনেকে আবার বলছেন, নিকট অতীতে ধামাচাপা পড়া বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনছে এই কৃষক আন্দোলন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি— যিনি ইতোমধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন— তাকে কিভাবে দেখছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব? দিল্লির সীমানায় প্রায় তিন মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত যেভাবে দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তার কেমন প্রভাব পড়ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে?
বিতর্কিত ৩ কৃষি আইন
ভারতের কৃষি আইনে উৎপাদিত পণ্য বা ফসল মজুতের ওপর সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিল। মনে করা হতো, এই সীমা না থাকলে মজুতদাররা অতিরিক্ত লাভ করবে।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দেশের কৃষি ব্যবস্থার সংস্কারে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তিনটি বিল উত্থাপন করে বিজেপি সরকার। তার প্রথমটিতে সেই সীমা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। সেখানে আরও বলা হয় যেসব সংস্থা বিদেশে খাদ্যশস্য রপ্তানি করে, তাদের পণ্য মজুদের বিষয়ে কোনো প্রকার বিধিনিষেধ চাপানো যাবে না।
মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারপ্রণীত বিতর্কিত আইনগুলোর ফলে লাভবান হবেন বড় কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও বহুজাতিক করপোরেট সংস্থাগুলো এবং ক্ষতির শিকার হবেন মাঝারি ও প্রান্তিক চাষীরা।
ভারতের রাজনৈতিক দল স্বরাজ পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদব এ বিষয়ে বলেন, এর ফলে ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কৃষিপণ্য মজুত করতে পারবে। যখন দাম কম থাকবে, তখন তারা পণ্য কিনবে এবং যখন দাম বেশি থাকবে, তখন তারা বেশি লাভ করবে। ফলে লাভবান হবেন বড় কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও বহুজাতিক করপোরেট সংস্থাগুলো এবং ক্ষতির শিকার হবেন মাঝারি ও প্রান্তিক চাষীরা।
দ্বিতীয় বিলে কৃষকদের চুক্তি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ফসল বোনার আগে কোনো কোম্পানির সঙ্গে কৃষককে চুক্তি করবেন, মাঠ থেকে ফসল তোলার পর তা কত টাকায় তিনি বেচতে পারবেন। তারপর সেই চুক্তি অনুযায়ী ওই কোম্পানির কাছে চুক্তিপত্রে লিখিত দামেই ফসল বিক্রি করতে হবে কৃষককে।
উৎপাদিত পণ্য সাধারণ বাজারে বিক্রি করতে না পারলে এতদিন ভারতের কৃষকরা সরকারি ফসল বিক্রয়কেন্দ্র, স্থানীয়ভাবে যা ‘মান্ডি’ নামে পরিচিত, সেখানে বিক্রি করতে পারতেন। মান্ডিতে সরকার যে দামে ফসল কৃষকদের কাছ থেকে কেনে তাকে বলা হয় ‘ন্যুনতম সহায়ক মূল্য’ বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি)।
বিলগুলো উত্থাপন হলে বিরোধী দলগুলোর চরম আপত্তি ও হট্টগোলে কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজ্যসভা; কিন্তু বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় কণ্ঠভোটে তা পাস হয়ে যায়।
তৃতীয় বিলে কৃষকদের যে কোনো বাজারে ফসল বেচার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলটির মাধ্যমে ধীরে ধীরে মান্ডি ব্যবস্থা উঠিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার।
২০ সেপ্টেম্বর এই বিলগুলো উত্থাপন হলে বিরোধী দলগুলোর চরম আপত্তি ও হট্টগোলে কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজ্যসভা; কিন্তু বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় কণ্ঠভোটে তা পাস হয়ে যায়। বিরোধীদের শেষ আশা ছিলেন রাষ্ট্রপতি। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি বিলগুলোতে স্বাক্ষর করায় তা আইনে পরিণত হয়।
রাষ্ট্রপতি যেদিন বিলগুলোতে স্বাক্ষর করেন, সেদিনই, অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর এই আইনগুলোর বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বিজেপিকে ছেড়ে যায় পাঞ্জাবের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল শিরোমণি আকালি। পরে মহারাষ্ট্রের প্রভাবশালী দল শিবসেনাও আকালি দলকে অনুসরণ করে বিজেপির সঙ্গত্যাগ করে।
আইনগুলোতে কৃষকদের লাভ তো হবেই না, বরং ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে। প্রথমে কৃষকদের বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কিছু কোম্পানি মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা করে নেবে। তারপর দাম একেবারে কমিয়ে দেবে। ফলে কৃষকরা পথে বসতে পারেন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, যতক্ষণ আইন করে ফসলের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য ঠিক না করা হচ্ছে এবং সেই মূল্য মানতে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য না করা হচ্ছে, ততদিন কৃষকদের লাভ তো হবেই না, বরং ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে। প্রথমে কৃষকদের বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কিছু কোম্পানি মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা করে নেবে। তারপর দাম একেবারে কমিয়ে দেবে। ফলে কৃষকরা পথে বসতে পারেন।
এদিকে গত ১২ জানুয়ারি নতুন তিন কৃষি আইনের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশে বলা হয়েছে, আইনগুলোর বৈধতা খতিয়ে দেখতে আদালতের উদ্যোগে কমিটি গঠন করা হবে। তারপর সেই কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ সম্পর্কে পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্ব
নভেম্বরে যখন কৃষকরা দিল্লি-হরিয়ানার সীমন্তবর্তী সিঙ্ঘুসহ বিভিন্ন এলাকার রাজপথ বা প্রধান সড়কগুলোতে সমবেত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন, এর কিছুদিন পর ১ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে সেই আন্দোলন সমর্থন করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনলাইন আলোচনা সভায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ভারতে কৃষক আন্দোলনের জেরে 'পরিস্থিতি উদ্বেগজনক' হয়ে উঠছে। ‘পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে কোনও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে সব সময় কানাডার সমর্থন থাকবে’ বলেও জানান তিনি।
এই মন্তব্য আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জানায়, একটি গণতান্ত্রিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর এভাবে ‘নাক গলানো’ বা ‘অযাচিত হস্তক্ষেপ’ সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে। মারা যান একজন কৃষক, আহত হন শতাধিক। আন্দোলনরত কৃষকরা ওইদিন দিল্লির লাল কেল্লায় ভারতের পতাকা ও তাদের আন্দোলনের পতাকা টাঙ্গিয়ে দেন।
এরপর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেস এবং যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্সে ভারতের কৃষক আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে রয়েছেন বলে জানালেও কংগ্রেসের অনেক সদস্য কৃষক আন্দোলনের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু না বললেও তার ভাইজি মিনা হ্যারিস এক টুইটবার্তায় জানিয়েছেন— তিনি কৃষক আন্দোলনের পক্ষে।
এর বাইরে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে তেমন কথাবার্তা প্রকাশ্যে না এলেও বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলো গোড়া থেকেই এ বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করে আসছে।
দিল্লিতে খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন অবস্থান নিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের অনেকেই তীব্র শীতের কারণে মারা যাচ্ছেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়ছেন— এ সংবাদ বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাতে এবং আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াও শুরু হয় তখন থেকে।
গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে সংঘাতের ঘটনায় তা আরও বিস্তার লাভ করে। ওইদিন কৃষকদের পূর্বঘোষিত ট্রাক্টর মিছিলে পুলিশ ও আধা সামরিক বা প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী বাধা দিলে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনরত কৃষকদের। সংঘর্ষে মারা যান একজন কৃষক, আহত হন আরও শতাধিক। অন্যদিকে দিল্লি পুলিশের দাবি, ওই ঘটনায় তাদের তিনশ সদস্য আহত হয়েছেন। আন্দোলনরত কৃষকরা এইদিন দিল্লির লাল কেল্লায় ভারতের পতাকা ও তাদের আন্দোলনের পতাকা টাঙ্গিয়ে দেন।
এ ঘটনায় ভারতের পতাকা যা ‘তিরঙ্গা’ নামে সাধারণভাবে পরিচিত, তার অবমাননা হলো কিনা এই নিয়ে যখন দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল বিতর্ক চলছে, সে সময় ২ ফেব্রুয়ারি কৃষক আন্দোলনের পক্ষে টুইট করেন মার্কিন তারকা রিহান্না, মিয়া খলিফা এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। জবাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নাক না গলানোর’ আহ্বান জানিয়ে পাল্টা টুইট করেন ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকার, ভারতের ক্রিকেট অধিনায়ক বিরাট কোহলি, সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর, অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতসহ বিনোদন ও ক্রীড়াঙ্গনের বেশ কয়েকজন তারকা। আবার বেশ কয়েকজন ভারতীয় তারকা কৃষক আন্দোলন এবং রিহান্নাদের টুইট সমর্থন করেও টুইট করেন। এরপর থেকে প্রায় দু-তিনদিন এ সংক্রান্ত পোস্ট-পাল্টা পোস্টের জোয়ারে ভেসে যায় টুইটার, বিভিন্ন ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যার নাম দিয়েছে ‘টুইটযুদ্ধ’। এই ‘টুইটযুদ্ধের’ তীব্রতা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে সংঘর্ষের উসকানির অভিযোগে গ্রেটা থুনবার্গের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করে দিল্লি পুলিশ এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত অভিযোগে প্রায় ১২শ’ টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার সুপারিশ করে টুইটারের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেয় ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে এশিয়া তথা প্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একটি প্রবণতা লক্ষণীয়, আর তা হলো এই দেশগুলোর জাতীয় নেতারা পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচকদের পাত্তা না দিয়ে নিজে যা ভালো বোঝেন, তা ই করেন। যেমন, উদাহারণ হিসেবে বলা যায়— ইউরোপ-আমেরিকা তুরস্ক সম্পর্কে কী বলল তা নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে কখনো বিচলিত হতে দেখা যায়নি। উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনও পাশ্চাত্যের সমালোচনাকে পাত্তা দিয়েছেন— এমন নজির দেখা যায়নি এখনো; আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তো বিশ্বাস করেন, সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ার অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে দেশটির সমালোচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র।
কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিজেপি সরকার এবং কৃষকদের মধ্যকার আস্থাহীনতা ও বৈরীতা দিন দিন বাড়ছে এবং সময় যত গড়াচ্ছে, সংকটও তত জটিল আকার নেওয়ায় সম্প্রতি একপ্রকার মেরুকরণ হচ্ছে ভারতের রাজনীতিতে।
তবে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার যদি এই পন্থা অনুসরণ করে, তা আখেরে ভালো ফল বয়ে আনবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে; কারণ ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সবসময়ই অন্য দেশের মতামত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজের প্রভাব বাড়ানোতে মন দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি এবং এক্ষেত্রে তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে বিজেপি। পাশাপাশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের কেন্দ্রীয় অবস্থান, দেশটির ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির দহরম মহরম সম্পর্ক।
কিন্তু কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিজেপি সরকার এবং কৃষকদের মধ্যকার আস্থাহীনতা ও বৈরিতা দিন দিন বাড়ছে এবং সময় যত গড়াচ্ছে, সংকটও তত জটিল আকার নেওয়ায় সম্প্রতি এক প্রকার মেরুকরণ হচ্ছে ভারতের রাজনীতিতে।
উপরন্তু আন্দোলন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈরী মনোভাবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমালোচনার জবাব যেভাবে দিচ্ছে বিজেপি, তাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপির ভাবমূর্তির কতখানি কল্যাণ হচ্ছে— সেই প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে ভারতের রাজনীতি বিশ্লেষকমহলে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে থামিয়ে দেওয়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে যতটা সহজ হয়েছে, সাম্প্রতিক ‘টুইটযুদ্ধে’ প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঠিক ততটাই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে দেশটির সরকার। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ কিংবা ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটির’ মতো এই অবস্থাকে আরও ঘনীভূত করেছে বিজেপির মাঝারি ও নিম্নসারির নেতাকর্মীরা তাদের ঘৃণা বিদ্বেষমূলক প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমে।
কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে টুইট করায় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ভাগ্নি মিনা হ্যারিস, রিহান্না ও গ্রেটা থুনবার্গের ছবি পোড়ানো কদর্য ও অশ্লীল ভাষায় আক্রমণাত্মক টুইট ইত্যাদির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যে বার্তা পৌঁছেছে তা হলো— যে ব্যক্তিই কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করবেন, তাকেই সম্ভাব্য সব রকম উপায়ে আক্রমণ করবে ক্ষমতাসীন সরকার ও বিজেপির সমর্থকরা।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতাকে যেখানে পাশ্চাত্যে শুধু লিখিতভাবে নয়, বাস্তব ব্যবহারিক জীবনেও অন্যতম প্রধান মানবিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় সেখানে এ ঘটনায় এরপর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের জনগণ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে কী চোখে দেখবেন, তা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
বিজেপি অবশ্য বিষয়টি এড়িয়ে চলতে চাইছে; দেশের জনগণ ও বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছে না। তবে তাতে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে করছেন না ভারতের রাজনীতি বিশ্লেষকরা; কারণ সরকার যতকিছুই করুক না কেন, সমালোচকদের মুখ যেমন বন্ধ থাকবে না তেমনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিজেপির আক্রমণাত্মক মাঝারি ও নিম্নপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভয়ে কৃষক আন্দোলন বিষয়ক সংবাদ পরিবেশন বন্ধ করে দেবে— এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। বরং তাদের আচরণে বিজেপির প্রতি আরও বেশি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব।
বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের প্রধামন্ত্রীর সামনে দু’টি পথ রয়েছে। ১. অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক জনমত উপেক্ষা করে বিজেপির মিত্রস্থানীয় শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষায় বিতর্কিত কৃষি আইনগুলো বহাল রাখা অথবা ২. নিজের এবং নিজ দলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আন্দোলনরত কৃষকদের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা। এর বাইরে আসলে তৃতীয় কোনো পথ নেই।
এসএমডব্লিউ/