দেশে দেশে বিক্ষোভ বাড়লেও সাফল্য মিলছে না কেন?
মানুষ তো ভেড়া নয় যে পাল ধরে সবসময় একই পথে হেঁটে চলবে। মানবজাতির ইতিহাস বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের ইতিহাস। মানুষ যেটা পছন্দ করে না বা যেটাকে ঘৃণা করে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে। এসব প্রতিবাদ না হলে হয়তো দাসত্ব, বর্ণবাদ আর অস্পৃশ্যতার মতো ব্যাধিগুলো চিরতরে সমাজে থেকে যেত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে দেশে অনেক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। দিনে দিনে বিক্ষোভ আরও বেগবান হচ্ছে। এসব বিক্ষোভের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা যেমন নেই, তেমনি জনমানুষের সম্পৃক্ততাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক রূপ নেওয়া এসব বিক্ষোভ সমর্থন পাচ্ছে নানা সংগঠন ও অধিকারকর্মীদের।
লাতিন আমেরিকার চিলি থেকে আফ্রিকার সুদান আর এশিয়ার হংকংয়ের সড়কজুড়ে লাখো মানুষ বিক্ষোভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিক্ষোভ হয়েছে অনেক দেশে।
২০১৯ সালজুড়ে লাতিন আমেরিকার চিলি থেকে আফ্রিকার সুদান আর এশিয়ার হংকংয়ের সড়কজুড়ে লাখো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ অনেক দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। অনেক দিক থেকেই বৈশ্বিক রুপ নিয়েছে এসব বিক্ষোভ। বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেও বিক্ষোভ হয়েছে অনেক দেশে। বিক্ষোভ ও বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে অনেক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতাও মুখ খুলেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আর বৈশ্বিক মানবাধিকার আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে তাদের এসব বিক্ষোভ দেশ আর আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দাবির সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করছেন বিক্ষোভকারীরা। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আর বৈশ্বিক মানবাধিকার আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে তাদের এসব বিক্ষোভ দেশ আর আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক।
দেশে দেশে এসব বিক্ষোভ যে শুধু অভ্যন্তরীণ বা দেশীয় কোনো ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ ছিল এমনটাও অবশ্য নয়। ইতিহাসও এর সপক্ষে কথা বলে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব এমন অনেক বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করেছে যেগুলো কোনো দেশের এক কোণা থেকে শুরু হওয়ার পরও ধীরে ধীরে তা বৈশ্বিক এক বিক্ষোভ ও জনঅসন্তোষে রূপ নিয়েছে।
অতীতে যে কোনো দেশের উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-প্রতিরোধ সবসময় বাইরের দেশের সমর্থন পেয়েছে, প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে। আয়ত্তের মধ্যে থাকা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সহায়তায় বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে; যা এর আগে দেখেনি বিশ্ব।
অধিকার আদায়ের এসব লড়াইয়ে অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও নৈতিক সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে ইস্যুভিত্তিক নানান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী, সংস্থা, সংগঠন ও নেটওয়ার্ক।
আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপনের জন্য আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অবারিত সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বিক্ষোভরত গোষ্ঠীগুলো। বিক্ষোভকারীরা যেন অধিকার আদায় করতে পারেন তাই তাদের অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও নৈতিক সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে ইস্যুভিত্তিক নানান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী, সংস্থা, সংগঠন ও নেটওয়ার্ক।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ণ কিংবা লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কিত যে কোনো বিক্ষোভ-প্রতিবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় বৈশ্বিক নেটওয়ার্কগুলোর কাছ থেকে সমর্থন পায়। একাত্মতা জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় কম কিন্তু নমনীয় আন্তঃসহযোগিতা ও সফল নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে দ্রুতই এসব অসুবিধা ও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেন তারা।
তবে একটা বিষয় খেয়াল করার মতো যে, যদিও প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলো আগের তুলনায় আরও বৃহত্তর ও বৈশ্বিক হয়ে উঠছে তারপরও উন্নত ও বিস্তৃত সংহতি তাদের দাবি আদায়ে সফলভাবে গড়ে তুলতে পারছে না।
প্রতিবাদ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যে সম্পর্কের গুণমান রয়েছে তার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বপূর্ণ ব্যারোমিটার; যা কোনো দেশে রাজনৈতিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতিবাদের প্রকৃতি এবং ফলাফলকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে।
অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় বৃহৎ পরিসরে বিক্ষোভ এবং বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের চাপ সফল হওয়ার জন্য নিশ্চিত কোনো বিষয় নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একদিকে বিশ্ব যেমন বৃহৎ পরিসরের বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছে, অপরদিকে বিশ্ব যে শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র থেকে ক্রমশ নিম্নমুখী স্বৈরতান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকছে সে বিষয়টিও বেশ স্পষ্ট।
মানুষের প্রতিবাদ হলো রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যে সম্পর্কের গুণমান রয়েছে তার প্রয়োজনীয়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যারোমিটার; যা কোনো দেশে রাজনৈতিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতিবাদের প্রকৃতি এবং ফলাফলকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক পরিসরে স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে বড় আকারে বিক্ষোভ হলেও প্রাণহানির তুলনামূলক কম।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কাঠামো এবং নীতিগুলো এমন যে তারা যেসব ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কম সেসব ক্ষেত্রে সম্মিলিত উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। যেমন বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হলে সরকার শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা সমাধানের চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভ-প্রতিবাদের পরিবর্তে তা যদি হয় বিদ্রোহ-জনঅসন্তোষ তাহলে প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা বদলে যায়।
বিক্ষোভ একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং এটি ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শাসকরা বিক্ষোভরত মানুষকে দমনে খুব কম সময়ই তাদের পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেন। কারণ বিক্ষোভ হলেও তা বিদ্রোহের মতো রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে না। বিক্ষোভটা মূলত হয় কিছু বিষয়ে বিরোধিতার জেরে। এটা হতে পারে সরকারি কোনো সংস্থা অথবা সংসদীয় কোনো প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান।
গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামোর ক্ষেত্রে প্রতিবাদ একটি অপরিহার্য চ্যানেল তৈরি করে; যার মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকরা সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়-পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন। বিক্ষোভ একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং এটি ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
জনগণকে একত্রিত ও সংগঠিত করা
বিশ্বজুড়ে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি মারাত্মক সংকটের মুখে পড়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শ ধরে রাখার ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জনতুষ্টিবাদের উত্থানে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে নতুন সংকট।
অতীতে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু করলে সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি করা হতো না। কেননা তাদের এই অধিকার ঐতিহ্য ও সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক পরিসরে মানবাধিকারকর্মী, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গোষ্ঠীগুলো সংহতি-সমর্থন দিলেও সরকার সেসব মেনে নিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় এই পরিস্থিতি এখন ভিন্ন।
শুধু নবীন ও দরিদ্র গণতন্ত্র নয় একইসঙ্গে উন্নয়নশীল এবং ধনী ও শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও কট্টর ডানপন্থী, ক্যারিশম্যাটিক ও বেপরোয়া নেতাদের অধীনে চলে গেছে।
বিগত ১৫ বছরে বিশ্বজুড়ে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি মারাত্মক এক সংকটের মুখে পড়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শ ধরে রাখার ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জনতুষ্টিবাদের উত্থানে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। শুধু নবীন ও দরিদ্র গণতন্ত্র নয় একইসঙ্গে উন্নয়নশীল এবং ধনী ও শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও কট্টর ডানপন্থী, ক্যারিশম্যাটিক ও বেপরোয়া নেতাদের অধীনে চলে গেছে।
দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের পর অনেক দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ধীরে ধীরে তা সংকর (হাইব্রিড) এক শাসনব্যবস্থার রুপ নিয়েছে। জনমত যাচাই বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ নয়, এসব দেশের স্বৈরচারী শাসকদের ক্ষমতা দখলের আইনি ভিত্তি তৈরির জন্যই নির্বাচনকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদের মিশ্রণে এই গুরুতর ত্রুটিযুক্ত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের অধিকার থাকলেও শাসকেরা এসব বিক্ষোভ-প্রতিবাদকে তাদের ক্ষমতা ও আর বৈধতার জন্য হুমকিরূপে বিবেচনা করছে। বিক্ষোভ দমন ও ছত্রভঙ্গ করতে শাসকশ্রেণী তাদের হাতে থাকা সব অস্ত্রই ব্যবহার করছে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা কিংবা সংকট সমাধানের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, নিতে চাচ্ছে না। ন্যুনতম ছাড় দেওয়ার নীতিও নিচ্ছে না তারা। সংকর শাসনব্যবস্থার দেশগুলোর কথিত ‘স্ট্রংম্যান’ নেতারা যে জনমানুষের দাবি মেনে নিচ্ছেন না, সেটা তাদেরই দুর্বলতার প্রমাণ। কারণ এটা হলে ক্ষমতায় টিকতে পারবেন না তারা।
বিক্ষোভ দমন ও ছত্রভঙ্গ করতে শাসকশ্রেণী তাদের হাতে থাকা সব অস্ত্রই ব্যবহার করছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা কিংবা সংকট সমাধানের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, নিতে চাচ্ছে না।
বিক্ষোভ আন্তর্জাতিক সমর্থন পেলে শাসকগোষ্ঠী তাকে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করে এর গুরুত্ব ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালায়। একই অপচেষ্টার মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমাও দেওয়া হয়। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বিক্ষোভকারীদের দেশের শত্রু হিসেবেও তুলে ধরেন শাসকরা।
সর্বোপরি এত কিছুর পরও যে ফলাফলটা দেখা যাচ্ছে, তা হলো বিশ্ব দিনে দিনে আরও বেশি করে বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছে। তাতে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে আন্তর্জাতিক সমর্থন। কিন্তু এসব বিক্ষোভ আসলে খুব সামান্যই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক, ত্রুটিযুক্ত ও সংকর শাসনকাঠামো।
এএস