পাকিস্তানের ক্যারিশমাটিক প্রধানমন্ত্রীর পতনের কারণ কী?
২০১৮ সালে ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন দেশটির প্রায় সবকিছুই তার পক্ষে ছিল বলে মনে করা হয়। ক্রিকেটের সোনালী সময় থেকেই একজন জাতীয় নায়ক হিসেবে দেখা হতো তাকে। পরবর্তীতে দেশটির ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন তিনি। কয়েক বছরের লড়াইয়ের পর পাকিস্তানে কয়েক দশক ধরে আধিপত্য করে আসা প্রতিদ্বন্দী দুই রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে সফল হন তিনি।
শনিবার গভীর রাতে সংসদে অনাস্থা ভোটে হারের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ইমরান খান। কিন্তু তার এই পতন কেন?
পাকিস্তানের রাজনীতিতে একেবারে নতুন উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন ইমরান খান। তার সমাবেশে নামে লাখো জনতার ঢল। আকর্ষণীয় সব গানে সমাবেশ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিশাল উপস্থিতি। তার দৃঢ় দুর্নীতিবিরোধী বার্তা মন কাড়ে পাকিস্তানিদের। খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশে ‘পরিবর্তন’ আনবেন, ‘নতুন পাকিস্তান’ গড়বেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাদের ক্ষমতার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ইমরান খানকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, যিনি মেয়াদ পূর্ণ করবেন।
নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালে ইমরান খানের উল্লেখযোগ্য এবং প্রকৃত জনসমর্থন ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতির অন্যতম ক্রীড়ানক হিসেবে যে গোষ্ঠীর কথা বলা হয়, সেই সেনাবাহিনীর সমর্থন ইমরান খানের প্রতি ছিল। দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সমালোচকরা ইমরান খানের সরকারকে ‘হাইব্রিড শাসকগোষ্ঠী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
ইমরান খানের প্রতি দেশটি মানুষের সমর্থন বিভিন্নভাবে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার মতো। ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেশটির গণমাধ্যম তার বিরোধীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ কমিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় বিরোধী কিছু প্রার্থী নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে অথবা ইমরান খানের দলে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সেনাবাহিনীর কথা উল্লেখ করে ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ ত্যাগ করা একজন সদস্য বিবিসিকে বলেন, ‘তাকে তারাই (সেনাবাহিনী) তৈরি করেছিল। তারাই তাকে ক্ষমতায় এনেছিল।’
যে কারণে তার অবস্থান এত সুরক্ষিত ছিল। তবে তার পতন ব্যাখ্যা করতেও সাহায্য করে এটি। যদিও উভয়পক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু এটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, ইমরান খান পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং এখন তাদের কারণেই তার পতন।
ইমরান খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দী বিরোধী নেতা নওয়াজ শরিফকে প্রথমে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। পরে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে। অনেকেই সন্দেহ করেন যে, নওয়াজ শরিফ আসলেই অতীতে দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই পর্যায়ে নওয়াজের শাস্তি পাওয়ার আসল কারণ ছিল সেনাবাহিনীর সাথে তার বিবাদ।
অধিক স্বাধীন হয়ে ওঠা এবং সেনাবাহিনীর ক্ষোভ উসকে দেওয়ার আগে সামরিক স্বৈরশাসকের শিষ্য হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন নওয়াজ শরিফ। যদিও সবসময় দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। একই সঙ্গে এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে, ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি এবং সেনাবাহিনী ‘একই পৃষ্ঠা’ বলে গর্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর ফলে পাকিস্তানে সুশীল সমাজের কর্মীদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দেয়। ইমরান খানের সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমালোচকদের ওপর হামলা এবং অপহরণের ঘটনা ঘটে। তবে উভয় কর্তৃপক্ষ এতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করলেও অন্য কোনো অপরাধীকে কখনই সনাক্ত করেনি।
ইমরান খান জোর দিয়ে বলেছিলেন, সুশাসন নিশ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য। তিনি সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার বেশ চমৎকার কিছু সম্প্রসারণ করেন। দেশটির বেশিরভাগ এলাকায় স্বাস্থ্যবীমা চালু করেন তিনি। তবে বেশ কিছু দিকে হোঁচটও খেয়েছেন পাক এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
যেমন— পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের মতো একজন নতুন রাজনীতিবিদকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্রূপের শিকার হন তিনি। এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হলেও তাকে সরিয়ে দিতে রাজি হননি তিনি। তবে সেই সময় গুজব ছড়িয়েছিল পড়েছিল, ইমরান খানের স্ত্রী, যিনি ধর্মীয় গুরু হিসেবে পরিচিত, তাকে সতর্ক করেছিলেন উসমান বুজদার তার জন্য শুভ শক্তি এবং তাকে সরিয়ে দিলে সরকারের পতন হবে।
ইমরান খানের জন্য অন্য আরো চ্যালেঞ্জ ছিল। দেশটির জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে চলেছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে এবং ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমে গেছে। খানের সমর্থকরা বলছেন এর পেছনে কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনরোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনগণের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত ছিল ‘শরিফ পরিবার হয়ত নিজেদের পকেট ভারি করেছে, কিন্তু তারা অন্তত কিছু কাজ করেছে।’
তারপরও কিছু দিনের জন্য সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভাল বিকল্প ছিলেন ইমরান খান। বিশ্বের দরবারে ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। কিন্তু সেনাবাহিনী— বিশেষ করে সেনাপ্রধান এবং গোয়েন্দাপ্রধানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের কণ্ঠ জোরালো হতে শুরু করে। আর গত বছর পাকিস্তানের রাজনীতির গতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিবিসিকে বলেছেন, পাঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ইমরান খানের ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীতে বিরক্তি বাড়ছিল। সম্ভবত তাকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে যে সমালোচনার মুখে সেনাবাহিনী ছিল সেটির প্রভাব পড়ছিল এতে।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া এবং গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ায়। ফায়েজ হামিদ পরবর্তী সেনাপ্রধান হওয়ার আশা পোষণ করতেন।
সেনাপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে এমনকি তিনি আফগান কর্মকর্তাদের সাথে সে ব্যাপারে কথাবার্তাও বলেছিলেন। যদিও সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছিল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার মত ‘নোংরা কাজে’ উপযুক্ত মনে করা হলেও তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে যোগ্য মনে করা হয়নি।
জেনারেল বাজওয়া এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল গত গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রভাবশালী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাথে এক আলাপচারিতার সময়। একজন সাংবাদিক প্রশ্নের জবাবে আইএসআই প্রধান বলে বসেন যে সময় শেষ হয়ে গেছে।
‘আমি হচ্ছি সেনাপ্রধান এবং আমি সিদ্ধান্ত নেব কখন সময় শেষ হবে’, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন জেনারেল বাজওয়া। এমনকি ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরও দেন সেনাপ্রধান। অক্টোবর মাসে তাদের দু’জনের বিরোধ চরমে পৌঁছায় আর এই বিরোধের মাঝে পড়ে যান ইমরান খান।
জেনারেল বাজওয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নতুন কারো কথা ভাবছিলেন এবং বিভিন্ন পদে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইমরান খান। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন পাক এই প্রধানমন্ত্রী।
পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আইএসআই প্রধানকে স্বপদে রাখতে চেয়েছিলেন ইমরান খান। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তাকে আরো একবার জয়ী হতে সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে করতেন তিনি। হামিদের পদ পরিবর্তন বিষয়ে প্রজ্ঞাপন প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আটকে রেখেছিলেন ইমরান খান। তবে শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয় তাকে।
এসব কারণে সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের সরকারের সম্পর্কের ফাটল প্রকাশ্য হয়। ইমরান খানের বিরুদ্ধে যখন অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনা হচ্ছিল, তার দল থেকে কারা বেরিয়ে যাবেন সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তখন বেশ কয়েকটি সূত্র থেকে বিবিসিকে বলা হয়েছিল, সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে বলে জানিয়েছে।
ইমরান খানের দলত্যাগী একজন সদস্য বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এবং অন্য সংসদ সদস্যরা গোয়েন্দা বাহিনী থেকে ফোন কল পেতেন এবং তাদেরকে বলে দেয়া হতো কি করতে হবে। ‘আমাদের সাথে ভালো আচরণ করা হতো না,’ বেশ বিরক্তির সাথে বলছিলেন তিনি।
তবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তার পদ থেকে সরে যাওয়ার পর এমন ফোন কল বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখন আর সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে না।’
বিবিসিকে সাংবাদিক কামরান ইওসাফ বলেছেন, সেনাবাহিনী ইমরান খানের মিত্রদের ‘সামাল’ দিয়ে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জায়গা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছিল। সমর্থন কমে যাওয়া তার পতন ডেকে আনল।
এসএস