বিদ্যুৎ-খাদ্য-ওষুধ-জ্বালানির সংকটে দুর্বিষহ পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কায়
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট চলছে শ্রীলঙ্কায়; দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপদেশটিতে দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে খাদ্যপণ্য ও ওষুধের দাম, সেই সঙ্গে পাল্লা দিতে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট।
এমনকি প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রার অভাবে বাইরে থেকে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যও আমদানি করতে পারছে না শ্রীলঙ্কা; এবং দেশের এই নাজেহাল পরিস্থিতির জন্য সরকারের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন নাগরিকরা।
বার্তাসংস্থা এএফপির বুধবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী কলম্বোসহ শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন শহরের কেরোসিন বিক্রির দোকানগুলোতে ভোরের সূর্য ওঠার আগে থেকেই ক্রেতাদের লাইন শুরু হয় প্রতিদিন। বুধবার সকালে কলোম্বোয় এরকম এক লাইনে দাঁড়ানো গৃহীনী সাগায়ারানির সঙ্গে কথা হয় এএফপি প্রতিবেদকের।
সাগায়ারানি বলেন, ‘আমি গত ৫ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। সকাল থেকে কিছু খাইনি।’
যে সারিতে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে তিনজন ইতোমধ্যে অজ্ঞান হয়েছেন। সাগায়ারানি জানান, যে কোনো সময় সংজ্ঞাহীন হয়ে যেতে পারেন তিনিও। তবে আপাতত এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, কারণ তার স্বামী ও সন্তান— দুজনেই কাজে গেছেন এবং তিনি কেরোসিন না নিলে বাসায় চুলা জ্বলবে না।
‘আমার খুবই দুর্বল লাগছে এবং এই প্রচণ্ড রোদের মধ্যে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব— জানি না। কিন্তু এ ছাড়া আর কী করতে পারি আমরা?’
জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট চলার কারণে ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে দেশটির পরিবহন ব্যবস্থা। বন্দরে খাদ্য, নির্মাণসামগ্রী ও চা-পাতা বোঝাই ট্রাকগুলো অলস বসে আছে, বন্ধ রয়েছে রাজধানীর ভেতরে চলাচলকারী গণপরিবহনসমূহও।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে রুটিন সার্জারি বন্ধ রেখেছে শ্রীলঙ্কার অনেক হাসপাতাল। কাগজের অভাবে স্কুল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
ভাদিভু নামে এক গৃহকর্মী এএফপিকে বলেন, ‘আমি গত ৬০ বছর যাবত কলম্বোয় বসবাস করছি। এত খারাপ পরিস্থিতি কখনও দেখিনি; খাবার নেই, পানি নেই….আমরা এখানে রাস্তায় ভিক্ষে করছি আর রাজনীতিবিদরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।’
জ্বালানির অভাবে পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কায় তীব্র হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ সঙ্কট। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছে দেশটিতে। এর মধ্যে বুধবার শ্রীলঙ্কার সরকারি বিদ্যুৎ পরিষেবা সংস্থা সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ড জানিয়েছে, এখন থেকে শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ এলাকা প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকবে।
এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘পর্যাপ্ত জ্বালানির অভাবে জেনারেটরসমূহ সারক্ষণ চালু রাখা যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ সীমিত রাখতে হচ্ছে।’
সরকারের অব্যাবস্থাপণাই কি দায়ী?
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এত খারাপ পরিস্থিতি কখনও দেখা যায়নি দেশটিতে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। ওই বছর দীর্ঘ খরার কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় শ্রীলঙ্কার কৃষি উৎপাদন এবং ইস্টার সানডেতে মুসলিম জঙ্গীগোষ্ঠীর বোমার আঘাতে প্রায় ৩০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পর্যটনশিল্প। অনেক বিদেশি পর্যটক শ্রীলঙ্কায় আসার পরিকল্পনা বাতিল করেন।
সেই ক্ষতি যখন সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি, সে সময়েই হানা দেয় করোনা মহামারি— যার প্রভাবে দীর্ঘ দুই বছর প্রায় বন্ধ ছিল পর্যটন খাত। ফলে দেশটির রিজার্ভের মজুতে টান পড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ একেবারে কমে যাওয়ায় সেই মজুত আর বাড়ানো যায়নি। বর্তমানে বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে শ্রীলঙ্কার আর্থিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
তবে দেশের সাম্প্রতিক এই দুরাবস্থার জন্য সরকারের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন কলোম্বোভিত্তিক থিংক ট্যাংক সংস্থা অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের মুরতাজা জাফেরজি।
এএফপিকে তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে বাজেট ঘাটতি, মহামারির আগে অযৌক্তিক কর কাটছাঁট এবং ধনী শ্রীলঙ্কানদের সুবিধা দেওয়ার জন্য সামঞ্জস্যহীনভাবে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য পরিষেবাখাতে যথেচ্ছ ভর্তুকি দেওয়ার ফলাফলই বর্তমানের এই দুর্বিষহ অবস্থার মূল কারণ।
এসএমডব্লিউ