পারমাণবিক কর্মসূচি চালাতে ৩০ কোটি ডলার চুরি করেছে উত্তর কোরিয়া
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালানোর জন্য উত্তর কোরিয়া ৩০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ চুরি করেছে বলে জাতিসংঘের একটি গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই দেশটির হ্যাকাররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এই অর্থ চুরি করে বলে ওই প্রতিবেদনের সূত্র দিয়ে জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সদস্য দেশের ধারণা, ২০২০ সালে উত্তর কোরিয়া-সংশ্লিষ্ট হ্যাকাররা ওই প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানা দিয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার চুরি করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩১ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলার। পরমাণু ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পের কারণে ২০০৬ সাল থেকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে উত্তর কোরিয়া।
গত বছর কয়েক দফা সামরিক মহড়ায় উত্তর কোরিয়া নতুন স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র এবং সাবমেরিনচালিত ও আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করেছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জানানো হয়। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর আকার বিবেচনা করে জাতিসংঘের ওই সদস্য দেশটি জানিয়েছে, ‘দূরপাল্লা এবং মাঝারি ও স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর ধারাবাহিকতায় বোঝা যায়, (ইতোমধ্যেই) উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র তৈরি হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, দূরপাল্লার ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত এবং পারমাণবিক সমরাস্ত্র উন্নয়নবিষয়ক প্রকল্প উত্তর কোরিয়া সরকার শুরু করেছে বলে গত বছর ঘোষণা দেয় পিয়ংইয়ং। আর এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সরবরাহে ইরানের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছায় কিম জং উনের প্রশাসন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য দেশ থেকে উপকরণ ও প্রযুক্তি নেওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যেই ফিসাইল মেটেরিয়াল উৎপাদন করেছে, পরমাণু কার্যক্রম চালু রেখেছে এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পদ্ধতির উন্নয়ন করেছে।
এছাড়া প্রকল্প ব্যয় নির্বাহে উত্তর কোরিয়ার সরকার অর্থের বিনিময়ে নিজের সমুদ্রসীমায় ইতোমধ্যেই কয়েকটি দেশকে মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে এবং জাতিসংঘের নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি কয়লা রপ্তানি করেছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। পাশাপাশি, পেট্রোলিয়াম আমদানির বিষয়ে দেওয়া জাতিসংঘের নির্দেশনাও পিয়ংইয়ং গতবছর লঙ্ঘন করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘উত্তর কোরিয়াকে বাৎসরিক ৫ লাখ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও ২০২০ সালে দেশটি জাতিসংঘের অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি পেট্রোলিয়াম আমদানি করেছে।’
অবশ্য পেট্রোলিয়াম আমদানির বিষয়ে উত্তর কোরিয়া যে জাতিসংঘের নির্দেশনা মানছে না- তার প্রমাণস্বরূপ স্যাটেলাইট চিত্রসহ অন্য তথ্য ইতোপূর্বে নিরাপত্তা পরিষদের উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তখন ওই অভিযোগকে পাত্তা দেয়নি ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন চীন ও রাশিয়া।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনটি এখনও প্রকাশিত হয়নি এবং এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। সিএনএন জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কূটনৈতিক সূত্রের মাধ্যমে তারা এই প্রতিবেদনের অংশ বিশেষ হাতে পেয়েছে। নামপ্রকাশ না করা শর্তে তিনি সিএনএন’র হাতে এই প্রতিবেদন তুলে দেন।
মার্কিন এই গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, সদস্য দেশ, গোয়েন্দা সংস্থা, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের নিকট থেকে তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে জাতিসংঘ। তবে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে কোনো তথ্য নেয়নি সংস্থাটি। সাধারণত প্রতি ছয় মাস অন্তর এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে তারা।
তবে কবে নাগাদ এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে তা অবশ্য নিশ্চিত নয়। কারণ এর আগে এ ধরনের প্রতিবেদন ফাঁসের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল রাশিয়া ও চীন। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে সৃষ্টি হয়েছিল কূটনৈতিক অচলাবস্থার।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও জাতিসংঘে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার মিশন কোনো মন্তব্য করেনি। তবে প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে কিম জং উনের নেওয়া সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার মিল রয়েছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের ক্ষমতাগ্রহণের মাত্র কয়েকদিন আগে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র সামনে আনে উত্তর কোরিয়া। সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য নতুন ধরনের এই ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র’ বলে সেসময় বর্ণনা করে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের উপস্থিতিতে নতুন এই ক্ষেপণাস্ত্রটি একটি কুচকাওয়াজ-এ প্রদর্শন করা হয়। এসময় পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক সক্ষমতা আরও বাড়ানোসহ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করার অঙ্গীকার করেন কিম।
অন্যদিকে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে অটল যুক্তরাষ্ট্র। তবে পিয়ংইয়ং কখনও জনসমক্ষে বলেনি, তারাও সেটা চায়। পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি। ফলে দেশটি সেই নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরোতে চায়।
সূত্র: সিএনএন
টিএম