ক্যান্সার শনাক্তের আগেই নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার
জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সিএনজি অটোরিকশাচালক দুলাল মিয়া। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তির জন্য সারাদিন ঘুরে ব্যর্থ হন তিনি। পরে এক স্বজনের পরামর্শে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান স্ত্রীকে। সিটিস্ক্যানসহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর চিকিৎসকের ফিতেই তার খরচ হয়ে যায় অর্ধ লক্ষাধিক টাকা।
পর দিন পরীক্ষার রিপোর্ট চিকিৎসককে দেখানোর পর জানানো হয়, দুলাল মিয়ার স্ত্রীর ক্যান্সার তৃতীয় স্টেজে রয়েছে, এ অবস্থায় অপারেশনের কোনো সুযোগ নেই। রেডিও আর কেমোথেরাপি চিকিৎসাই একমাত্র ভরসা। আর এ চিকিৎসার জন্য প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হবে।
সঙ্গে নিয়ে আসা প্রায় সব অর্থ একদিনে শেষ হয়ে যায় দুলাল মিয়ার। তার ওপর পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়ার খরচ শুনে ভেঙে পড়েন তিনি। আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় রাজধানীর একজন হোমিও চিকিৎসক দেখিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।
দুলাল মিয়া জানান, ঢাকায় আসার আগেই বিভিন্ন স্থানে স্ত্রীর চিকিৎসায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। বন্ধক দিতে হয়েছে একমাত্র ফসলি জমি। এবার শেষ সম্বল হিসেবে আছে তার একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। স্ত্রীকে ওই হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে হলে তার শেষ সম্বলটুকুও হারাতে হবে। তাই নিকটাত্মীয়দের পরামর্শে স্ত্রীর চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি ওষুধই তার ভরসা।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে দেখা মেলে হাবিবুর রহমান নামে আরেক রোগীর। ২০ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে তিনি এসেছেন।
ক্যান্সার আক্রান্ত হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যান্সার ইনস্টিটিউট পর্যন্ত আসার আগেই চিকিৎসা বাবদ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে তার। এখন হাসপাতালে রেখে ছয়টা কেমোথেরাপি দিতে হবে, তারপর অপারেশন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন চিকিৎসাও চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে আসার আগেই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়ে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন তিনি।
শুধু দুলাল মিয়া কিংবা হাবিবুর রহমানই নয়, সারাদেশে এমন অসংখ্য রোগীই আছেন, যাদের কাছে মরণব্যাধি ক্যান্সার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগের চিকিৎসা করাতে এসে তাদের অনেকেই দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃতদের তালিকায় স্থান পাওয়াদের অধিকাংশই এশিয়ার বাসিন্দা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮১ জন ছিলেন। ওই বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১ লাখ ৮ হাজার ১৩৭ জন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। সময়ের ব্যবধানে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারে ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে তাদের প্রায় ১৭ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব, রোগ শনাক্তে সারাদেশে ব্যবস্থা না থাকা আর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসায় রেফারেল সিস্টেমসহ সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন না থাকাকে দায়ী করছেন।
ড. আব্দুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে যারা ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছে তাদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখেছি, একজন রোগীর পেছনে সাড়ে ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেগে যায়। আর এই খরচটা মূলত ক্যান্সারের ধরনের ওপর অনেকটা নির্ভর করে। আমরা যদি ধরে নিই গড়ে ৭ লাখ টাকার মতো খরচ হচ্ছে, তাহলে এই বিশাল খরচের কারণ হিসেবে বলব আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকা। আমরা দেখছি যে, একজন রোগীর রোগ শনাক্ত হওয়া পর্যন্ত যেতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ক্যান্সারের যেসব উপসর্গ রয়েছে, সেগুলো দেখে শুরুর দিকে রোগী, তার স্বজন বা স্থানীয় চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন না যে তার ক্যান্সার হয়েছে। রোগী বা তার স্বজনরাও শুরুতে যান গ্রাম-গঞ্জের ফার্মেসিতে বসা কোয়াকের কাছে, সেখান থেকে কিছু ওষুধ খাওয়ার পর তারা যান সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে তারা আরও কিছুদিন সময়ক্ষেপণ করার পর বড় কোনো হাসপাতালে যান। সবশেষে বড় হাসপাতালে যাওয়ার পর ওই ব্যক্তির ক্যান্সার শনাক্ত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। একই সঙ্গে অনেক টাকা-পয়সা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু ওই ব্যক্তি যদি শুরুতে বুঝতে পারতেন যে তার ক্যান্সার হয়েছে, তাহলে কিন্তু তার এত সময় ও অর্থের অপচয় হতো না।
সৈয়দ আব্দুল হামিদ আরও বলেন, একজন রোগীকে তার ক্যান্সার শনাক্তের পূর্বেই লাখ লাখ টাকা এদিক-সেদিক খরচ করতে হচ্ছে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে ক্যান্সারের পরীক্ষা সহজলভ্য না থাকার কারণে। এই লাখ টাকা খরচ করার আগেই যদি ব্যক্তির ক্যান্সার শনাক্ত হয়ে যেত, এবং সে যদি তখনই ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করতে পারত, তাহলে তার সময় ক্ষেপণও হতো না, এতো টাকা-পয়সাও খরচ হতো না।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এখানে মূল সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে, আমরা প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারছি না। কিন্তু আমরা যদি দ্রুত শনাক্ত করতে পারতাম, সেই সঙ্গে যদি আমাদের কোনো রেফারেল সিস্টেম থাকত, এবং আক্রান্ত ব্যক্তি কোথায় যাবে কোথায় চিকিৎসা হবে সেটির যদি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকত, তাহলে সাধারণ মানুষকে এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিভাগীয় আটটি মেডিকেলে যদিও রেডিওলোজী বিভাগ আছে, কিন্তু সেখানে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ কতটুকু আছে তা আপনারাই ভালো জানেন। যে কারণে রোগীদের পুরোটাই নির্ভর করতে হচ্ছে ঢাকার ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওপর। পাশাপাশি যে কয়টা বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। তবে এখন আটটি বিভাগে ক্যান্সার হাসপাতাল হচ্ছে, যত দ্রুত এটি চালু হবে, এবং সেখানে যদি ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায়, তাহলে হয়ত রোগীদের কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
এদিকে দেশে জাতীয়ভাবে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট ক্যান্সার রোগতত্ত্ববিদ ও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। একইসঙ্গে ক্যান্সার শনাক্তে জাতীয় কোনো ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে অন্যান্য রোগের মতো জনগণের ক্যান্সার সেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রয়েছে। তারপরও প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার রোগী নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার রোগীই মারা যাচ্ছে। এটা ঠিক যে, বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে শুধু সরকারের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
হাবিবুল্লাহ রাসকিন বলেন, সঠিক পরিকল্পনার জন্য সঠিক পরিসংখ্যান দরকার। একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে হাসপাতাল ভিত্তিক নিবন্ধন চালু আছে কিন্তু জনগোষ্ঠী ভিত্তিক নিবন্ধন এখনো চালু করা যায়নি। এ কারণে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের হার মৃত্যুর হারসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান নেই।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে কোনো জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেই। বিএসএমএমইউয়ে একটি প্রকল্পের অধীনে স্তন ও জরায়ু মুখের ক্যান্সারে স্ক্রিনিং চলছে। তবে জাতীয়ভাবে স্তন, জরায়ু মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার অন্তর্ভুক্ত করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত উপযুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিজ্ঞানসম্মত সংগঠিত কর্মসূচি চালু করা উচিত।
এছাড়াও ক্যান্সারের প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য হেপাটাইটিস বি ও হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকাদান ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বিশেষ করে সাড়ে ১০ কোটি নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে, এ মরণব্যাধিতে আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছর ২০ থেকে হাজারের অধিক লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসে। ক্যান্সারের ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ মেটাতে গরিবতো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও নিঃস্ব হতে হয়। এ জন্য আমাদের শুরু থেকে প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে। সবধরনের তামাক বর্জন, মেয়েদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে না দেওয়া এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি খাবার টেবিলে শাক-সবজি খেলে অনেক ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, গত ৯ জানুয়ারি ক্যান্সার চিকিৎসাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে আটটি বিভাগে ক্যান্সার হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে সরকার। এসব হাসপাতালে ক্যান্সারসহ অসংক্রামক সকল রোগ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
উল্লেখ্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্যান্সার হলো অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগের সমষ্টি। এখন পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত করা যায় না। ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোনো চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না।
চিকিৎসকদের মতে, ক্যান্সার সারানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশ বেড়ে যায়। ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেকটির ধরনই আলাদা। চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন।
টিআই/এসকেডি