‘ক্যান্সার, স্ট্রোকের চেয়েও মারাত্মক হৃদরোগ’
দেশে ক্যান্সার, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের চেয়েও হৃদরোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অন্য রোগের চেয়ে এই রোগে মৃত্যু হার অর্ধেকের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (এনসিডিসি) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে ৪.৫ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত। হৃদরোগের পেছনে সবচেয়ে বড় তিনটি কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ, তামাক ব্যবহার ও লিপিড প্রোফাইল (কোলেস্টেরল)। আমাদের হৃদরোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে বেশি জোর দিতে হবে।
বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রোবেদ আমিন বলেন, বাংলাদেশে ১৯৬০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মৃত্যু নিয়ে একটা পরিসংখ্যান হয়েছে। ১৯৬০ সালে আমাদের প্রায় মৃত্যুর হার ছিল প্রতি লাখে ২০ জনের মত। সেটা পরবর্তীতে কমে এখন গড়ে ১১ তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও দেখেন অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। যার মধ্যে হৃদরোগ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, আমরা অনেকে চিন্তা করি যে স্ট্রোকে মৃত্যু হয়ত বেশি, আসলে কিন্তু তা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের মাধ্যমে অথবা হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, হার্ট ফেলিওর এমন একটা জটিলতা, যা এতো ভয়ংকর যে, এটা ক্যান্সার থেকেও মারাত্মক। আপনারা যদি ক্যান্সারজনিত মৃত্যু, শ্বাসকষ্টজনিত মৃত্যু অথবা ডায়াবেটিসের জটিলতায় মৃত্যুর কথা বলেন, এগুলোর কোনটাই কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের মৃত্যুর কাছে কিছুই নয়।
হৃদরোগের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই রোগের জন্য অনেকগুলো ফ্যাক্টর দায়ী। কিন্তু তিনটা ফ্যাক্টরকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফাউন্ডেশন। এগুলোর প্রথমটি হলো হাইপার টেনশন (উচ্চ রক্তচাপ), অন্যটি হলো ধূমপান, আরেকটি হলো লিপিড প্রোফাইল (কোলেস্টেরল)। যদিও ডায়াবেটিস, ওবিসিটি থেকে শুরু করে আরও অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে, তবুও এই তিনটা ফ্যাক্টরকেই গুরুত্ব বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আমাদের দেশে শহর এবং গ্রামভিত্তিক হৃদরোগ চিকিৎসার সমতা নেই। আমাদের হৃদরোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করার বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সকল স্তরের মানুষকেই সচেতন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক আরও বলেন, হৃদরোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশের অনেক অর্জন রয়েছে। রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজের বিরুদ্ধে আমরা অনেক ভালোভাবে জয়লাভ করতে পেরেছি। আমাদের অসংখ্য কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ আছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা জয়লাভ করতে পেরেছি। কিন্তু আমরা যেখানে পিছিয়ে আছি সেটা হল ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ। এ জন্য এই দিবসটিকে অন্যান্য দিবসের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা করা হয়েছে এবং এই যে প্রতিপাদ্য দেওয়া হয়েছে এটার অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল বলে আমি মনে করি।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, হৃদরোগসহ অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বর্তমান সরকার ২০১৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। হৃদরোগ প্রতিরোধের অংশ হিসেবে বর্তমানে সিলেট বিভাগ এবং জামালপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার ৫৪টি উপজেলায় উচ্চ রক্তচাপ কর্মসূচি চলমান, যেখানে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। সারাদেশের সব উপজেলায় ধীরে ধীরে এই কর্মসূচি বিস্তৃত করা হবে।
এদিকে ‘হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের যত্ন নিন’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সপ্তাহব্যাপী নানা আয়োজনে এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করেছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় এ ভার্চুয়াল গণমুখী সেমিনার আয়োজন করা হয়। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া। ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, দেশে চিকিৎসা সেবার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে হৃদরোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে তা জেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে।
ওয়েবিনারে জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক বলেন, দেশে স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত যে অবকাঠামো রয়েছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী। এটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে হৃদরোগসহ অন্যান্য যেকোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হৃদরোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অনেকের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা সম্ভব হয় না। সে জন্য হতদরিদ্রদের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিত। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা যেতে পারে।
ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল (রিজভী)। তিনি বলেন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ হৃদরোগের চিকিৎসা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। সারাদেশে এই ফাউন্ডেশনের ৪৫টি অ্যাফিলিয়েটেড বডি রয়েছে, যারা তৃণমূল পর্যায়ে হৃদরোগ প্রতিরোধে কাজ করছে।
টিআই/এসকেডি