সহকর্মীদের ঈদ পালনের সুযোগ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় তারা
ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। মুসলমানদের ঈদ থেকে শুরু করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা আর খ্রিস্টানদের বড়দিন এবং বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমার উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে যায় দেশের সবার মাঝে। এবারের ঈদুল আজহাতেও সে আমেজের কমতি হয়নি।
অন্যবারের মতো মুসলিম সহকর্মীদের পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উদযাপনের সুযোগ দিয়ে এবারও রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত অন্য ধর্মাবলম্বী চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে তারা রোগীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করছেন ঈদ আনন্দ।
রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত ডা. দীপঙ্কর রায় তার সহকর্মী ডা. মারুফ হাসানকে পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে ঈদ পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ডা. দীপঙ্কর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিজে থেকেই তাকে বলেছি, আজ ডিউটিতে না এসে রোস্টার অনুযায়ী অন্যদিন দায়িত্ব পালন করতে। কারণ, আমাদের পূজাসহ বিভিন্ন সময়ে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেন। তাই ঈদে তাকে সুযোগ করে দেওয়া আমার দায়িত্ব।
তিনি বলেন, করোনার কারণে ডা. মারুফ গত দুই ঈদ বাসায় করতে পারেননি। আমরা একসঙ্গে ডিউটি করেছি। তাই এ ঈদের ডিউটির দায়িত্বটা আমিই নিয়েছি। হাসপাতাল এমন এক জায়গা, যেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হলে সেটি আর বন্ধ হয় না। ক্রমাগত রোগী আসতে থাকলে, কর্মরত চিকিৎসকদেরও দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। হোক সেটা ঈদ বা পূজা। সেক্ষেত্রে কাউকে না কাউকে তো সেবায় এগিয়ে আসতে হবে।
দীর্ঘদিন পর পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সুযোগ পেয়ে খুশি ডা. মারুফ হাসান অভিও। সহকর্মীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ডা. দীপঙ্কর আমার সঙ্গে ডিউটি চেঞ্জ করে নিয়েছেন। আমি গতকালও নাইট ডিউটি করেছি। আর আজ ঈদ হওয়ায় তিনি আমাকে বললেন, ‘পরিবারের সঙ্গেই থাকুন, আজকের দিন আমি দেখছি’। এটি ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। আর এটি বাংলাদেশেই সম্ভব।
শুধু ডা. দীপঙ্করই নন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের মতো অন্যান্য হাসপাতালেও এমন সম্প্রীতি দেখা গেছে। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. প্রজ্ঞা পারমিতা অঙ্কুর এবারের ঈদে রোগীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন। তিনি বলেন, আমরা দুজন সনাতন ধর্মাবলম্বী সহকর্মী ঈদে দায়িত্ব পালন করছি। এ নিয়ে চারটি ঈদ হাসপাতালেই করছি। রোগীদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করছি। ভালোই লাগছে।
ডা. প্রজ্ঞা বলেন, করোনার কারণে হাসপাতালের পরিবেশ খুবই ভয়াবহ। সরাসরি রোগীদের কাছে আমাদের যেতে হচ্ছে, চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। তারপরও ভালো লাগছে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের সময়টা রোগীদের সঙ্গে থাকতে পারছি, চিকিৎসা দিতে পারছি।
তিনি আরও বলেন, ঈদ মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও আমরা সবাই মিলে উদযাপন করি। ঈদের দিন আমার অনেক মুসলিম বন্ধু ‘ঈদ মোবারক’ জানিয়েছে। আমিও ‘ঈদ মোবারক’ জানিয়ে এসএমএস করেছি। ঈদ, পূজা, বড়দিন বা বুদ্ধপূর্ণিমা- যেকোনো পার্বণ উপলক্ষে আমরা যদি ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে পরস্পরকে শুভ কামনা জানাতে পারি, তবেই তো মানবতার জয় হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা এ বি এম খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন থেকেই সনাতন-মুসলমানদের নানা অনুষ্ঠানে ধর্মীয় সম্প্রীতি দেখে আসছি। ঈদে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মীয় সহকর্মীকে শুধু শুভেচ্ছা-ই জানান না, একজন আরেকজনের প্রয়োজনেও পাশে দাঁড়ান। চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের আমরা প্রায়ই দেখি, ঈদ বা পূজা উদযাপন করার সময় তারা দায়িত্ব ভাগ করে নেন। এটি নিঃসন্দেহে ভালো একটি দিক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন।
তিনি বলেন, হাসপাতালে সনাতন ধর্মের চিকিৎসকরা থাকেন, তারা প্রতি বছরই মুসলিম চিকিৎসকদের পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালনের সুযোগ দেন। তবে যেসব হাসপাতালে একেবারেই চিকিৎসক নেই, সেগুলোতে হয়তো মুসলমান চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। বরাবরই তারা এভাবে সাপোর্ট দিয়ে থাকেন।
খুরশীদ আলম বলেন, আমাদের পক্ষ থেকেও চেষ্টা করি, যারা হাসপাতালে কাজ করেন, তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু যেন ঠিকঠাক থাকে। সেজন্য প্রতিটি হাসপাতালকে আলাদা করে বলেও দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আজ হয়তো হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের খোঁজ নিতে বের হতে পারিনি, তবে প্রতিটি হাসপাতালেই ফোনে খোঁজখবর নিয়েছি। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা কী অবস্থায় আছেন, তারা ঠিক মতো খাচ্ছেন কি না বা কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না- এসব বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। ঈদ-আনন্দ বিসর্জন দিয়ে যারা মানুষের সেবায় কাজ করেন, তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
করোনায় আক্রান্ত আট হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত তিন হাজার ২৪ জন চিকিৎসক ও দুই হাজার ১৪২ জন নার্সসহ মোট আট হাজার ৪৫২ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এ তথ্য জানিয়েছে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।
ঢাকা জেলায় ৮৫৮ জন, চট্টগ্রাম জেলায় ৪৯২ জন ও সিলেট জেলায় ৩৪৯ চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এ তিন জেলায় আক্রান্ত চিকিৎসকদের সংখ্যা বেশি। নার্সদের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায় ৮১৯ জন, ময়মনসিংহে ১৬৪ জন, সিলেটে ৮৩ জন।
বিএমএ জানায়, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন তিনজন ডেন্টাল সার্জন ও ১৬৬ জন চিকিৎসক। তাদের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন ২৩ জন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ৭৩ জন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত/অবসরপ্রাপ্ত সাতজন, বেসরকারি/জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স ৬২ জন এবং আর্মি মেডিকেল কলেজে কর্মরত একজন রয়েছেন। এছাড়াও ডেন্টাল চিকিৎসকদের মধ্যে দুজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং একজন বেসরকারি/জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স ছিলেন।
টিআই/আরএইচ