জিপি-রেফারেল সেবা বাস্তবায়নের পূর্বে বিস্তর গবেষণার তাগিদ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরবান জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) পরিষেবা এবং রেফারেল ব্যবস্থা বাস্তবায়নের আগে এটার বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা, নীতিমালা, পরিকল্পনা ও সম্ভাব্য সমস্যাগুলো যাচাই করতে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে শহরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণে জিপি পরিষেবা এবং তার সাথে একটি সমন্বিত রেফারেল ব্যবস্থার বাস্তবায়ন একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে বলেও মনে করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (২৪ মার্চ) বাংলাদেশ আরবান হেলথ নেটওয়ার্ক (বিইউএইচএন) আয়োজিত জিপি পরিষেবা এবং রেফারেল ব্যবস্থা বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ভার্চুয়াল সেশনে নগর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে আরবান জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) পরিষেবা এবং রেফারেল ব্যবস্থার গুরুত্ব নিয়ে নগর স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞগণ বিস্তারিত আলোচনা করেন। তারা বলেন, বর্তমানে শহরগুলো দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে আর তার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দক্ষতার সাথে, যথাযথ ও পর্যাপ্ত ভাবে নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় একটা শক্তিশালী রেফারেল ব্যবস্থা গুরুত্বের দাবিদার। এমন বাস্তবতায় জিপি পরিষেবা এবং রেফারেল ব্যবস্থা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, এই ব্যবস্থায় আর কোন কোন প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করতে হবে তা নিয়েও বক্তারা আলোকপাত করেন।
বিজ্ঞাপন
সেমিনারে সেশন চেয়ার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্টের (ব্যবস্থাপনা ইউনিট) প্রজেক্ট ডাইরেক্টর খন্দকার মো. নাজমুল হুদা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ডাক্তারের কাছে যাওয়া খুব সহজ। এ দেশে আমরাই সিদ্ধান্ত নেই কে হবে আমার ডাক্তার। এভাবে আমরা পুরো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করি। তাই দেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই।
একটি সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ফলপ্রসূ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার আহবান জানান তিনি।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও যোগ করেন, হেলথ রেকর্ড সংরক্ষণ করাটা জরুরি। সেই সঙ্গে রিপোর্টগুলো যেন অনলাইনে সংরক্ষণ করা যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রায়শই দেখা যায় চিকিৎসকরা অনেক রিপোর্ট গ্রহণ করতে চান না। এটা নিয়েও কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ আরবান হেলথ নেটওয়ার্কের (বিইউএইচএন) সভাপতি এবং ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ডা. খাইরুল ইসলাম বলেন, এই সপ্তাহে আমরা সম্ভবত হেলথ রিফর্ম কমিশনের রিপোর্ট পাব, যেখানে আমি প্রত্যাশা করছি জিপিভিত্তিক নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার মডেলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন আউটলাইন, গবেষণা পদ্ধতি, কীভাবে রেফারেলগুলো কাজ করবে, রেফারেল মেথডলজি ইন ডিজিটাল ফরমেট ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে যা বিবেচনা করা যায়। রেফারেলগুলো কীভাবে অটোমেটিক কাজ করবে, কীভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হবে সেটা জিপির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।
সেমিনারে শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের নগর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর। এরপর রেফারেল স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তথ্য চিত্র উপস্থাপন করেন ইউএনএফপিএ’র প্রোগ্রাম এনালিস্ট মো. আজমল হোসাইন। তার দেখানো চিত্রে বলা হয়, দেশে বস্তির সংখ্যা অনেক বেশি। এসব বস্তিত মাত্র ১৩% বাসিন্দা সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। পাশাপাশি বস্তিবাসীর নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরেন তিনি।
এসময় বাংলাদেশ আরবান হেলথ নেটওয়ার্কের (বিইউএইচএন) মেম্বার সেক্রেটারি এবং এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভলপমেন্টের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, আমি আশা করছি প্রস্তাবিত জিপি এবং রেফারেল সিস্টেম আমাদের সহযোগিতা করবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ৭০% মানুষ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত যা এখনো প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আসেনি। বাস্তবে অসংক্রামক ব্যাধির জন্য স্বাস্থ্য সেবার সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক কারণসমূহ এবং নগর স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার যা পরিবেশ, যাতায়াত এবং পয়োনিষ্কাশনের সাথে সম্পর্কিত। অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে আমাদের সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাকেই শুধু বিবেচনা করলে হবে না বরং সামাজিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশগত ইস্যু, পয়োনিষ্কাশনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেও বিবেচনা করতে হবে। আমরা আশা করছি স্থানীয় সরকার জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশগত ইস্যু এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়ে নেতৃত্ব প্রদান করবে।
নগর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মো. জহিরুল আলম আজাদ বলেন, মানুষ ফার্মেসি থেকে কেন চিকিৎসা নিতে যায় সেটি আগে জানতে হবে। সে বিবেচনায় জিপি সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রেফারেল সিস্টেম আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই। সে জন্য পুরোনো পলিসিকে পরিমার্জন করে নতুন পিলিসি যুক্ত করতে হবে। সেই সাথে এআইকে সংযুক্ত করতে পারলে জিপি সার্ভিসের সাফল্য আরো ত্বরান্বিত হবে।
তিনি বলেন, যথাযথ নিয়ম না মানলে জিপি সিস্টেম বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তার মতে জিপি সিস্টেম শুধু পাবলিক হাসপাতালে হবে নাকি সবগুলো হাসপাতালে হবে সেটি নিয়েও বিস্তর আলোচনা দরকার।
আইসিডিডিআর,বির গবেষক ইমা আক্তার বলেন, নগর স্বাস্থ্যসেবায় বেশ কিছু ফাঁক-ফোকর আছে। বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ উনারা খুঁজে বের করেছেন। তিনি মনে করেন জিপি সিস্টেম এই সমস্যা মোকাবেলা করতে পারবে। তাই জিপি ক্লিনিকের উপর ফোকাস দিতে হবে আর আইসিডিডিআর,বি এক্ষেত্রে ভালো সহযোগিতা করতে পারবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, জিপি এবং রেফারেল সিস্টেম নিয়ে আমাদের আলাদা একটা সেমিনারের আয়োজন করা দরকার। তরুণ সাংবাদিকরা এই বিষয়ে অবগত আছে এবং কাজ করছেন এটা আশাব্যঞ্জক। সারা দেশে এই বিষয়ের কাজ এগিয়ে নিতে সাংবাদিকগণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
সেমিনারে বাংলাদেশ হেল্থ রিপোর্টার্স ফোরাম সভাপতি রাশেদ রাব্বী বলেন, জিপি সেন্টার কেন দরকার, এটি ছাড়া নগর স্বাস্থ্য বর্তমানে কীভাবে চলছে সেটি নিয়েও আলোচনা করা প্রয়োজন। জিপি সেন্টার করার পর চিকিৎসা নিয়ে কি করা হবে, তার পরিকল্পনাই বা কি? আমি মনে করি, এসব বিষয় নিয়ে আরও বিস্তার গবেষণা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে শুধু শুধু সরকারের টাকা খরচ হবে, কোনো লাভ হবে না।
এসময় ঢাকা পোস্টের সিনিয়র রিপোর্টার তানভীরুল ইসলাম বলেন, জিপি এবং রেফারেল সিস্টেম এই দুটি আশানুরূপ অগ্রগতি প্রয়োজন। শহরের ৬০% মানুষ প্রাইভেট মেডিকেলের ওপর নির্ভরশীল কারণ সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা খুব ধীরগতির। রেফারেল সিস্টেমের একটা দুর্বলতা হলো আমাদের সামগ্রিক কোনো মডেল নেই। ৬৫% রোগী জিপির সার্ভিস সম্পর্কে জানেন না। নগর স্বাস্থ্য সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। এই বিষয়ে প্রচার এবং প্রসার দরকার। সরকারি এবং বেসরকারি এই দুই সেক্টরের সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন।
উক্ত সেমিনারে আরও অংশ ইউনিসেফ বাংলাদেশের হেলথ ম্যানেজার নেন চন্দ্র সেগারার সলোমন, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আব্দুর রাজ্জাকুল আলম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা ডা. সাবেরা সুলতানাসহ আরও অনেকে।
প্রসঙ্গত, সাধারণ অসুস্থতার ক্ষেত্রে প্রাথমিক (প্রাইমারি) পর্যায়ের চিকিৎসা প্রদান করেন যে চিকিৎসকগণ তারাই জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা জিপি বলে পরিচিত। রোগীরা তাদের সমস্যা নিয়ে একজন জিপির কাছে যাবেন। একজন জিপি রোগীর প্রয়োজনীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন। সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা বা রোগ নিরাময়ে একজন জিপিই যথেষ্ট। কিন্তু প্রয়োজন সাপেক্ষে জিপি এসব রোগীকে আরও উচ্চতর স্বাস্থ্য সেবার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন, এটাকেই রেফারেল ব্যবস্থা বলে।
এই রেফারেল ব্যবস্থায় সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে রোগীদের উচ্চতর রোগের চিকিৎসকের কাছে যাবার প্রয়োজন পড়ছে না। তারা জিপি সেন্টারে গিয়েই প্রযোজ্য চিকিৎসা পেয়ে যাবেন। অন্যদিকে উচ্চতর সমস্যার রোগীও পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য কার কাছে ও কোথায় যেতে হবে সে সংক্রান্ত একটা দিক-নির্দেশনা পেয়ে যাবেন। এভাবে যেমন সময় ও অর্থের সাশ্রয় সম্ভব হবে তেমনি উচ্চতর সমস্যার রোগীদেরও সাধারণ সমস্যার রোগীদের ভিড়ে চিকিৎসকের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হবে না। এভাবে দক্ষতার সাথে ও কার্যকর উপায়ে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
টিআই/এমএ