ভয় ছড়ানো ‘এইচএমপিভি’ আক্রান্ত আছে দেশেও
ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা দিয়ে বিদায় নিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। তাই নতুন করে যে কোনো ভাইরাসের খবরেই এখন আঁতকে ওঠেন সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) নামক এক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় জনমনে আবারও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের দাবি, এইচএমপিভি ২০০১ সাল থেকেই বাংলাদেশে আছে। এমনকি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট অ্যান্টিবডিও তৈরি হয়েছে। যে কারণে করোনাভাইরাসের মতো এই ভাইরাস নিয়ে এতো ভয়ের কিছু নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, ২০০১ সালে বিশ্বে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়ত আরো অনেক যুগ আগে থেকেই এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। কেউ কেউ বলছেন, ১৯৫৮ সাল থেকেই রোগটা আছে বলেও যোগসূত্র পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
সিডিসি বলছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে কোনো বয়সী মানুষের ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মত অসুখ হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এটি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল তাদের মধ্যেই বেশি দেখা গেছে।
এইচএমপিভি নিয়ে অযথাই উদ্বেগের কোনো কারণ নেই : ডা. মুশতাক হোসেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএমপিভি ভাইরাসটা করোনার মতোই দ্রুত ছড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা ভালো হয়ে যায়। তবে, কখনো কখনো গুরুতর সমস্যা হতে পারে, যা নিয়ে এতটা ভয় বা চিন্তার কিছু নেই বলেও মনে করেন তারা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে অযথাই উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তবে রোগ যেন না হয় সেই চেষ্টা করা উচিত। কারণ ভাইরাসটি যতবেশি ছড়াবে, তত বেশি তার চরিত্র বদলের সুযোগ পাবে।’
এইচএমপিভি সাধারণত আক্রান্ত মানুষের হাঁচি বা কাঁশি থেকে ছড়ায়। এছাড়া স্পর্শ বা করমর্দনের মত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শেও এইচএমপিভি ছড়াতে পারে
তিনি বলেন, ‘ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যে স্বাস্থ্য বিধিগুলো আছে, সেগুলো মেনে চলা দরকার। বিশেষ করে নিয়মিত হাত ধোঁয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, এছাড়াও যারা এই রোগে আক্রান্ত আছে যথাসম্ভব ঘর থেকে বের না হওয়া। যদি কারও শরীরে তিন দিনের জ্বর থাকে, তাহলে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর যদি এরমধ্যে সুস্থ হয়ে যায় তাহলে চিন্তার কিছু নেই।’
এইচএমপিভি ভাইরাসটি কোভিডের মতোই কি-না, জানতে চাইলে মুশতাক হোসেন বলেন, ‘কোভিড হলো ভিন্নধর্মী এক ভাইরাস, যার এ ভাইরাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কোভিড ভাইরাসটি শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশকেই দুর্বল করে দেয়। কিন্তু এই ভাইরাসটি বলতে গেলে অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। তবে এটি করোনার মতোই দ্রুত ছড়ায়।’
যেহেতু এই ভাইরাসটি আগে থেকেই বাংলাদেশে আছে, এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে বলেও মনে করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
প্রতিবছরই দু-চারজন এইচএমপিভি রোগী পাওয়া যায় : ডা. তাহমীনা শিরিন
নতুন করে ২০২৫ সালে এসে আতঙ্ক ছড়ালেও এইচএমপিভি নামক ভাইরাসটিতে প্রতিবছরই দু-চারজন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন।
তিনি বলেন, হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। এটা শুধু চীনেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি আরও আগে থেকেই আমরা পেয়েছি। কাজেই এটা নতুন কোনো ভাইরাস নয়।
তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা সর্বপ্রথম এই পরীক্ষাটি করেছি, তখনই কয়েকজন শনাক্ত পেয়েছিলাম। হয়তো এর আগেই যদি পরীক্ষা করা হতো, তাহলে আগেই শনাক্ত হতো। সুতরাং ঠিক কবে এই ভাইরাসটি দেশে এসেছে, সেটি বলা সম্ভব নয়। তবে প্রতিবছরই কমবেশি শনাক্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সার্ভিলেন্সটা যে আমাদের রেগুলার করা হয়েছে তা নয়, কোনো সময় আমরা নোটিফিকেশন পেলে তখনেই আমরা করি। তবে এই সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে আমরা প্রতিবছরই ২-৪ জন এইচএমপিভি রোগী পেয়েছি। তার মানে এই না যে এই ২/৪ জন রোগীই দেশে আছে। আমরা মনে করি অবশ্যই এরচেয়ে অনেক বেশি আছে। যদি ব্যাপক হারে সার্ভিলেন্স করা যেত, তাহলে হয়তো রোগীও বেশি পাওয়া যেত।’
আইইডিসিআর পরিচালক আরও বলেন, ‘আমরা সর্বশেষ গত বছরেও ৩ জন রোগী পেয়েছিলাম, যারা ৩/৪ দিনের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে যায়। তাই এটা নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর মতো কিছু নেই। এটি অন্যান্য সাধারণ ভাইরাসের মতোই।’
এইচএমপিভি কীভাবে ছড়ায়, লক্ষণ-ঝুঁকিতে কারা?
এইচএমপিভি সাধারণত আক্রান্ত মানুষের হাঁচি বা কাঁশি থেকে ছড়ায়। এছাড়া স্পর্শ বা করমর্দনের মত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শেও এইচএমপিভি ছড়াতে পারে।
এ বিষয়ে আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলছে, এইচএমপিভি রয়েছে এমন বস্তু বা স্থান স্পর্শ কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাঁশির ড্রপলেট লেগে থাকা স্থান যেমন দরজার হাতল, লিফটের বাটন, চায়ের কাপ ইত্যাদি স্পর্শ করার পর সে হাত চোখে, নাকে বা মুখে ছোঁয়ালে এইচএমপিভি ছড়াতে পারে।
এ বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ দেখা যায়, এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ অনেকটা একই রকম। এইচএমপিভি সংক্রমিত ব্যক্তির জ্বর হবে, হাঁচি-কাশি হতে পারে, কাশি থেকে কারো কারো গলা ব্যথা হতে পারে।’
‘অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগটি জটিলতা বাড়াতে পারে। যাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যেমন: শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের ঝুঁকি বেশি। যারা অন্যান্য রোগে ভুগছেন, যেমন: ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, ক্যানসার, কিডনিজনিত জটিলতা, অ্যাজমা আছে। এমনকি কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্যও রোগটি জটিলতা বাড়াতে পারে।’
চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এই ভাইরাসের চিকিৎসা খুবই নরমাল। এর কোনো অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ বা কোনো ভ্যাকসিনও নেই। নরমাল সর্দি-কাশিতে আমরা যে চিকিৎসা করি, এই রোগের ক্ষেত্রেও একই চিকিৎসা। কেউ এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বড় কোনো জটিলতা তৈরি না হলে সাধারণত ৩/৪ দিনের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে যায়। তবে কোনো কোন ক্ষেত্রে ৬/৭ দিনও লেগে যেতে পারে। এই রোগে মারা যাওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।’
ভাইরাসটির সার্ভিলেন্সে জোর দেওয়ার পরামর্শ ডা. মুশতাক হোসেনের
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাসটি একদম নতুন না হলেও, এর বিষয়ে প্রাথমিক সচেতনতায় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ এখন ভাইরাসটির নতুন কোনো মিউটেশন হয়েছে কিনা বা এটি আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়েছে কিনা তা এখনো জানা যায়নি। তাই দেশে ভাইরাসটির সার্ভিলেন্সে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে যখন ভাইরাসটি নেদারল্যান্ডে পাওয়া যায়, তখন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্তদের থেকে স্যাম্পল পরীক্ষা করে ভাইরাসটির উপস্থিতি পেয়েছে। বলা যায় যে তখন থেকেই ভাইরাসটি বাংলাদেশে আছে।
এ মুহূর্তে করণীয় প্রসঙ্গে মুশতাক হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে সরকার ভাইরাসটির সার্ভিলেন্স করার জন্য আইইডিসিআরকে দায়িত্ব দিতে পারে। বাংলাদেশে কোভিডের সার্ভিলেন্স হয়েছে, ইনফ্লুয়েঞ্জারও সার্ভিলেন্স আছে। এসবের পাশাপাশি যেন এইচএমপিভি ভাইরাসের সার্ভিলেন্সটা গুরুত্ব দিয়ে করা হয়। এতে করে ভাইরাস থেকে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারবো, এমনকি ভার আসছে তার রূপ পাল্টাচ্ছে কিনা বা কোন অবস্থায় আছে সে বিষয়ে আমরা পরিষ্কার ধারণা নিতে পারবো।
চীন-জাপানে ছড়িয়ে পড়েছে এইচএমপিবি ভাইরাস
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া চীনের কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালগুলোতে করোনাভাইরাসের সময়ের মতোই ভিড়। এছাড়া জাপানেও একই অবস্থা দেখা যায়। দেশগুলোতে এই রোগ নিয়ে সতর্ক অবস্থানেও যেতে দেখা যাচ্ছে। তবে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়লেও এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কিংবা দেশগুলোর সরকার সতর্কতা জারি করেনি।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্যে জানা যায়, চীনে এই রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। বিশেষ করে আগে যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল, তারা নতুন এই ভাইরাসের আক্রমণে নাজুক অবস্থায় আছেন। এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার জন্য বলেছে চীন।
তারা জানায়, এটি মৌসুমি অর্থাৎ শীতকালীন সংক্রমণ মাত্র।
ভারতেও দুজনের শরীরের এইচএমপিবি ভাইরাস
চীন, জাপান ও মালয়েশিয়ার পর ভারতেও শনাক্ত হলো হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)। সোমবার (৬ জানুয়ারি) সকালে দেশটির কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে দুটি শিশুর শরীরে এইচএমপিভি শনাক্ত হয়।
দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির তথ্যে জানা যায়, সোমবার সকালে বেঙ্গালুরুতে প্রথমে আট মাস বয়সী এক শিশুর শরীরে এইচএমপিভি ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। পরে তিন মাসের এক শিশুর শরীরেও এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে ভারতের কর্ণাটকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দীনেশ গুন্ডু রাও বলেন, এই ভাইরাস নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। এইচএমপিভি ভারতেও রয়েছে। তবে এই ভাইরাসের রূপান্তর হয়েছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অতীতেও ভারতে সাধারণ এইচএমপিভি দেখা গেছে বলে জানান তিনি।
টিআই/এমএসএ