৬ দাবিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের বিক্ষোভ
স্বতন্ত্র পরিদপ্তর-দ্রুত নিয়োগসহ ৬ দফা দাবিতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। কর্মসূচিতে দাবি আদায়ে দ্রুততম সময়ে যদি সরকার পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আগামীতে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) বৈষম্যবিরোধী জাতীয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট পরিষদের আয়োজনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা মেডিকেলসহ অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
এসময় বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা একটি টিম ওয়ার্ক যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে চিকিৎসক ও নার্সদের পাশাপাশি মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও রোগীদের সেবাদান কার্যক্রমে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো রোগ নির্ণয়। আর এই রোগ নির্ণয়ের পুরোধা বলা হয় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদেরকেই। কোভিডকালীন সময়েও লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি যখন পুরো বিশ্বকে অস্থির করে তুলেছিল, তখন জীবনের মায়া ত্যাগ করে মানুষের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। এছাড়াও দেশের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই পেশাজীবিরা ঝাঁপিয়ে পড়লেও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পেশাটি কখনই সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং সুযোগ-সন্ধানীরা উল্টো নানাভাবে অবদমনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
তারা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গাইডলাইন অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে হাসপাতালগুলোতে ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে দীর্ঘ ১৪ বছরেরও বেশি সময় প্রশাসনিক জটিলতার কারণে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সংখ্যা মাত্র ৪ হাজার ১০৬ জন, যেখানে মোট পদ আছে ৫৯৭৫টি। অথচ চিকিৎসক ও নার্সের বিদ্যমান সংখ্যার অনুপাতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হওয়ার কথা ছিল ৮০ হাজারেরও বেশি।
কর্মসূচি প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী জাতীয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট পরিষদের সভাপতি আব্দুস সামাদ বলেন, স্বাস্থ্য সেক্টরে সবচেয়ে অবেহেলিত একটি পেশা হলো মেডিকেল টেকনোলজি। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় মেডিকেল টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা একটি বড় অংশেরই সরকারি চাকরিতে আবেদন বয়সসীমা পার হয়ে গেছে। নিজস্ব কোনো দপ্তর না থাকায় দক্ষতা থাকার পরও বেকার হয়ে বড় সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠী একপ্রকার হতাশাগ্রস্ত জীবন যাপন করছে। এদিকে নিয়োগ জটিলতা কেটে গেলেও ২০১৩ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি এখনও নানাবিধ অযুহাতে আটকে রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কেবলমাত্র চিকিৎসককেন্দ্রীক দপ্তর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে বক্তারা আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেবলমাত্র পেশাদার চিকিৎসকদের সামগ্রিক সুবিধা আদায়ের একটি প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত হয়েছে। এর যাবতীয় সুবিধা, পদ-পদবি, পদোন্নতিসহ সামগ্রিক দিক থেকে কেবলমাত্র চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণে ও তাদেরকেই দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে। নীতিনির্ধারণী সব জায়গায় অন্য স্টেকহোল্ডারদের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ না থাকা এবং একপেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাকি সব জনবলকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু বণ্টনে সকলের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ এবং ন্যায্য বিষয়।
এসময় সংগঠনটির মহাসচিব মো. রিপন শিকদার বলেন, মেডিকেল টেকনোলজি শিক্ষায় ডিপ্লোমার পাশাপাশি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেডিকেল টেকনোলজির বিষয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষা চালুর বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও গ্র্যাজুয়েটদের জন্য কোনো ধরনের পদ সৃজন করা হয়নি। ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের (হাই-ভোল্টেজ) কমিটি মেডিকেল টেকনোলজি শিক্ষায় সনদপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্টেদের জন্য একাডেমিক, ক্লিনিক্যাল ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ শাখায় উপজেলা থেকে বিভাগীয় হাসপাতাল, ইনস্টিটিউটে ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলোতে পদ সৃজন সংক্রান্ত অর্গানোগ্রাম প্রস্তুত ও চূড়ান্ত সুপারিশ করলেও নানাবিধ বল প্রয়োগের মাধ্যমে তা আটকে আছে বছরের পর বছর।
গ্রেড উন্নয়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ও ফার্মাসিস্টদের দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের বিষয়টি নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়েই এ পেশার পথচলা শুরু হলেও ১৯৮৯ সাল পরবর্তী মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট পেশাজীবীদের দশম গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দারিটি অব্যাহতভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে বারবার উপস্থাপিত হয়ে আসছে। অধিকার বাস্তবায়নে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন, সংগ্রাম, সহায়ক কর্মসূচি পালন, দাপ্তরিক চিঠি চালাচালি, আবেদন, সর্বোপরি জনপ্রশাসন বিধি শাখার সব চাহিদা পূরণ করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের সদিচ্ছার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নানাবিধ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় অবিরতভাবে কোয়ারি দেয়ার মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ ও জটিলতাই তৈরি করেছে।
মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের দাবিগুলো হলো- স্বতন্ত্র পরিদপ্তর গঠন করতে হবে। ডিপ্লোমাধারীদের ১০ম গ্রেড (২য় শ্রেণির গেজেটেড) পদমর্যাদা প্রদান করে ডব্লিউএইচও এর আনুপাতিক হারে পদ সৃষ্টি করে দ্রুত নিয়োগ করতে হবে ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০১৩ সালের স্থগিত করা নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের নবম গ্রেডের পদ সৃষ্টিপূর্বক চাকরিজীবীদের আনুপাতিক হারে পদোন্নতির নিয়ম বহাল রেখে স্ট্যান্ডার্ড সেট আপ নিয়োগবিধি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ঢাকা আইএইচটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব আইএইচটিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ক্যারিয়ার প্ল্যান গঠন করে বিদ্যমান নিয়োগ বিধি ও অসংগতিপূর্ণ গ্রেড সংশোধন করতে হবে। মেডিকেল টেকনোলজি কাউন্সিল ও ডিপ্লোমা মেডিকেল এডুকেশন বোর্ড গঠন এবং প্রাইভেট সার্ভিস নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বি ফার্মসহ সব অনুষদের বিএসসি ও এমএসসি কোর্স চালু করা এবং স্কলারশিপসহ প্রশিক্ষণ ভাতা চালু করতে হবে।
টিআই/জেডএস