গরমের আরাম শরবতে, কিন্তু কতটা স্বাস্থ্যকর?
রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র ও মাঝারি তাপপ্রবাহ। প্রতিদিন তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। কাঠফাটা রোদ আর তীব্র দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
গরমে কাহিল রাজধানীর নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে ফুটপাতে বিক্রি হওয়া ঠান্ডা শরবত এখন অমৃতের মতো। রং-বেরঙের এসব শরবত বিক্রি হচ্ছে ঢাকার দুই সিটির প্রায় সব সড়কের ফুটপাতে। বিশেষ করে বাস স্টপেজের পাশে কিংবা মার্কেটের সামনে এসব ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। দলে দলে মানুষ শরবত খাচ্ছেন সেখানে।
কিন্তু রঙিন এসব শরবত কতটা স্বাস্থ্যকর? বিভিন্ন সময় চিকিৎসকরা বলে আসছেন ফুটপাতের এসব শরবত স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ, এই শরবতে ব্যবহৃত পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ নয়।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রাজধানীর পল্টন ও গুলিস্তানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শরবত বিক্রির ধুম চোখে পড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, গরমে মানুষের চাহিদা বাড়ায় শরবতের দোকান আগের তুলনায় বেড়েছে।
সাধারণত রিকশাচালক, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষই বেশি ভিড় করেন এসব শরবতের দোকানে। এখন চাকরিজীবী বা শিক্ষিত লোকজনও নিয়মিত শরবত খাচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রিকশাচালক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, রাস্তায় ডিউটিরত পুলিশ সদস্যসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই স্বস্তি খুঁজছেন ফুটপাতের এসব পানীয়তে। সবাই বলছেন, গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত, শরবতের বিকল্প নেই। অফিসগামী কিছু মানুষ বাসা থেকে শরবত-স্যালাইন বানিয়ে আনলেও সেগুলো গরমের কারণে আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।
আরও পড়ুন
বায়তুল মোকাররম এলাকায় আক্তার হোসেন নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের তো বাইরে ঘুরে ঘুরে ডিউটি করতে হচ্ছে। পুলিশ ভ্যানে গিয়ে বসলেও মনে হয় ভেতরটা আগুন হয়ে আছে। এ অবস্থায় চোখের সামনে শরবত পেলে না খেয়ে তো আর থাকা যাচ্ছে না। তৃষ্ণা মেটানোর উপায় এটাই। ভালো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, তারপরও শরবতের পানির উৎস জানার চেষ্টা করি। তারা তো বলে ভালো পানি.. । এই যে এখান থেকে যে শরবতটা খেলাম, ওরা বলছে বায়তুল মোকাররমের ভেতর থেকে পানি নিয়ে এসেছে।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গেছি, শরবত দেখে লোভ সামলাতে পারছি না
গাজীপুর থেকে ব্যক্তিগত কাজে মাকে নিয়ে পল্টনে এসেছেন গার্মেন্টস কর্মী মো. রায়হান। প্রচণ্ড রোদে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা হাঁপিয়ে গেছেন তারা। গাড়ি থেকে নেমেই তারা শরবত কিনে খান।
ফুটপাতের শরবত কতটা বিশুদ্ধ বা স্বাস্থ্যকর সে বিষয়ে কিছু জানেন কি না-- জানতে চাইলে রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এত গরমে আসলে চিন্তাভাবনা করে কিছু খাওয়ার সুযোগ নেই। হাতের কাছে যা পেলাম তাই খাচ্ছি। তৃষ্ণা তো মেটাতে হবে। ভালো-খারাপ চিন্তা করলে নিয়মিত খাওয়া হয় এ রকম অনেক কিছুই খেতে পারব না।
তিনি বলেন, বাইরে এত পরিমাণ রোদ, মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। এত গরম আমি আমার জীবনে কখনো দেখিনি। সুস্থ থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
গরমে ব্যবসা বাড়ায় ফুরফুরে মেজাজে শরবত ব্যবসায়ীরা
গরম বেড়ে যাওয়ায় ফুটপাতের দোকানগুলোতে শরবত বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। শরবতের ধরনও বাড়িয়েছেন বিক্রেতারা। এর মধ্যে লেবুর শরবতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া রয়েছে ইসবগুলের ভুসি, অরেঞ্জ পাউডার, শাহীদানা, অ্যালোভেরা, বেল, পেঁপে, আখ ও মাল্টার ঠান্ডা শরবত।
বিক্রেতারা জানান, পানির ফিল্টারের মধ্যে বরফ, লেবু ও ‘ড্রিংক পাউডার’ মিশিয়ে তৈরি করা হয় শরবত। কেউ কেউ এসব শরবতে আরও ব্যবহার করেন পেঁপে, আপেল ও বেদেনাসহ নানা ধরনের ফলমূল। মানভেদে এক গ্লাস শুধু লেবুর পানি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর ড্রিংক পাউডার ও ফলমূল মেশানো লেবুর পানি বিক্রি হয় প্রতি গ্লাস ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত।
বায়তুল মোকাররম গেটে শরবত বিক্রেতা মো. শহিদ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় এখন চাহিদা আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমি দিনে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার শরবত বিক্রি করি। বেশি রোদ থাকলে একটু বেশি লাভ হয়, আবার বৃষ্টি চলে আসলে ওইদিন মাঝেমধ্যে লসও হয়। গরম বেশি থাকলে মানুষ প্রচুর পরিমাণে শরবত খায়। গত কয়েকদিন আলহামদুলিল্লাহ ভালো বেচাকেনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময়টা আমাদের পিক টাইম। এই সময়ে সবচেয়ে ভালো বিক্রি হয়। আমার শরবত বিভিন্ন অফিস আদালতে আসা মানুষজন বেশি খায়। যে কারণে শরবতের মানটা আমি ভালো রাখার চেষ্টা করি। এছাড়া, রিকশাওয়ালা আর শ্রমজীবীরাও নিয়মিত শরবত খায়।
পানিতে সমস্যা নেই, সবাই খায়, আমরাও খাই
মারুফ মিয়া নামে এক শরবত বিক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরমের কারণে বিক্রি ভালোই হচ্ছে। দিনে কত গ্লাস বিক্রি হয় এটা কখনো আমরা হিসাব করি না। তবে, গরম বেশি থাকলে আল্লাহর রহমতে ৯০ লিটারের তিন বালতির মতো শরবত বিক্রি করা যায়।
শরবত বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মারুফ মিয়া বলেন, ইসবগুলের ভুসি ও তোকমাসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল আমরা ব্যবহার করি। যে পানিটা ব্যবহার করি, সেটাও বিশুদ্ধ পানি। বায়তুল মোকারম মসজিদের সাবমারসিবল পাম্প থেকে নেওয়া হয়।
গুলিস্তান এলাকায় করিম নামে আরেক শরবত বিক্রেতা বলেন, গরমে মানুষ লেবুর পানি বেশি খায়। চাহিদা বেশি বলে বিক্রিও বেশি হয়। রোদ উঠলেই অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষকে আমি শরবত খাওয়াই।
পানির বিশুদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলে করিম বলেন, ওয়াসার লাইনের পানি, সমস্যা নাই। সবাই খায়, আমরাও খাই।
ফুটপাতের শরবতে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছেন চিকিৎসকরা
দিনে অন্তত প্রায় ৬০০ মানুষের কাছে একজন বিক্রেতার শরবত বিক্রি হলেও তারা গ্লাস ব্যবহার করেন মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি। একজনের খাওয়া শেষ হলে পানি দিয়ে ধোয়ার পর সেই গ্লাসেই আবার শরবত পরিবেশন করা হয় আরেকজনকে। আবার লেবুর রস যে যন্ত্র দিয়ে চিপে বের করা হচ্ছে, তাতেও ময়লা জমে থাকে। এসব কারণে ফুটপাতে শরবতে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছেন চিকিৎসকরা।
খোলা শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বির অ্যাসিস্ট্যান্ট সাইন্টিস্ট (নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশন) ডা. সারিকা নুজহাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, তীব্র গরমের কারণে আমাদের হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। আমরা আশঙ্কা করছি আগামী ১/২ সপ্তাহের মধ্যে রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, যেহেতু গরমটা বেশি, মানুষ বেশি তৃষ্ণার্ত থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে ফুটপাতের শরবতসহ নানা ধরনের খাবার কিনে খায়। কিন্তু অনেকে জানে না, বাইরের এসব পানীয়-খাবারে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার খুব কম হয়। ফলে এসব খেলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাটা বেড়ে যায়। সবার জন্য পরামর্শ হলো, বাইরের এসব খোলা পানীয় বা শরবত কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। বাইরে কাজ বের হলে অবশ্যই বাসা থেকে বিশুদ্ধ পানি বোতলে করে সাথে নিয়ে যেতে হবে।
করণীয় জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফুটপাতের শরবত খাওয়া মোটেই উচিত নয়। কারণ, এগুলোতে ব্যবহার হওয়া পানিটা বিশুদ্ধ কি না আমরা কেউই তা জানি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পানি বিশুদ্ধ হয় না। আর এগুলো খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু পানি আর শরবতই নয়, এই সময়টাতে বাইরের সব ধরনের খোলা খাবার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
গরমে ভালো থাকতে হলে সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে এ অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে কাজ করে তাদের ঝুঁকিটা একটু বেশি। তারা ডিহাইড্রেশনের (পানিশূন্যতা) ঝুঁকিতে থাকে, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া আর সর্দি-কাশি তো আছেই। এজন্য একটানা এক ঘণ্টার বেশি রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, সম্ভব হলে পরিমাণ মতো লবণ মিশিয়ে খেতে হবে। আরও ভালো হয় যদি দুয়েকটা ওরস্যালাইন খাওয়া যায়। কারণ হলো গরমে ঘামের সাথে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ লবণ বের হয়ে যায়। যে কারণে শুধু পানি খেলে সেটা অনেক সময় ঘাটতি পূরণ করে না। তাই লবণ মিশিয়ে খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
সুখবর দিতে পারছে না আবহাওয়া অধিদপ্তর
এদিকে, বুধবার (১৭ এপ্রিল) সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাট জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় তা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
টিআই/কেএ