মাত্র ১০ টাকাতেই মিলছে আইসিইউ সেবা!
দেশে ক্রমেই তীব্র হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপ। হাসপাতালগুলোতে দেখা দিচ্ছে আক্রান্ত রোগীদের চাপ, যাদের অধিকাংশই হন্যে হয়ে ছুটছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য। একটি শয্যা আর সুস্থ হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এ সুযোগে আইসিইউ’র ভাড়া সাধারণ সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি রাখা হচ্ছে। ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে রোগীর পরিবার, কেউ কেউ হচ্ছেন নিঃস্ব।
অপরদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এ চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নতুন চালু হওয়া ডিএনসিসি মার্কেটে ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে অতিরিক্ত কোনো খরচ হয় না। শুধু ভর্তি টিকেট বাবদ ১০ টাকাতেই মিলছে আইসিইউসহ বাকি সব চিকিৎসা। বেসরকারি হাসপাতালে লাখ লাখ টাকার ভিড়ে নামমাত্র টাকায় আইসিইউ সেবা পেয়ে দুঃখের দিনে স্বস্তি মিলছে রোগীর স্বজনদেরও।
গণমাধ্যমকর্মী তৈমুর ফারুক তুষার। করোনা আক্রান্ত শ্বশুরকে নিয়ে শুরুতে ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। রোগীর অবস্থা কিছুটা অবনতি ঘটলে আইসিইউতে নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, দুই সপ্তাহে অন্তত ১০-১৫ লাখ টাকা বিল আসতে পারে, যা ব্যবস্থা করা তাদের জন্য অনেকটাই দুরূহ। অবশেষে রোগীকে নিয়ে চলে আসেন মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেটে নির্মিত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে। মাত্র ১০ টাকাতে রোগীকে ভর্তি করে আইসিইউ সেবা পাচ্ছেন তিনি একেবারেই বিনামূল্যে।
এই প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য মাত্র ১০ টাকায় ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালে আইসিইউ বেড পেয়েছি। প্রাইভেট হাসপাতালে জানিয়েছিল, প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে এবং দুই সপ্তাহের জন্য রাখা লাগতে পারে। এর ওপর নানা খরচ তো আছেই। মানে হলো, অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ব্যাপার। তিন দিন প্রাইভেট মেডিকেলে থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার টাকার ওষুধের বিল দিতে হয়েছে। কিন্তু ডিএনসিসির হাসপাতালে বেশিরভাগ ওষুধই তারা দিচ্ছে। আমাদের কিনে দিতে হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকার ওষুধ।’
তৈমুর ফারুক তুষার বলেন, ‘আমাদের মতো মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে পরিস্থিতি জটিল হলে সরকারি চিকিৎসা সেবা না পেলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে। এর চিকিৎসা ব্যয় যোগাড় করা আমাদের মতো মানুষদের পক্ষে দুঃসাধ্য। ফলে করোনা থেকে দূরে থাকার চেষ্টাই চলমান মহামারি মোকাবিলায় আমাদের মূল কৌশল হওয়া উচিত।’
অন্যদিকে, একটি বেসরকারি ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে চিকিৎসা করানো মীর হাসান নিয়াজ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চার দিন হাসপাতালে অবস্থান করতে হয় তাদের। এর মধ্যে আইসিইউতে থাকতে হয় দুদিন। অবশেষে মা সুস্থ হলেও হাসপাতালের বিল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মীর হাসান নিয়াজ। বলেন, ‘দুদিনে শুধু অক্সিজেন ব্যবহার করে আইসিইউ বিল দিতে হয়েছে দুই লাখ টাকা। চিকিৎসার নামে আমাদের গলাকাটা হয়েছে এখানে। ডাকাতি বললেও ভুল হবে না।’
শুধু ওই হাসপাতালটিই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেই করোনা চিকিৎসায় গলাকাটা বিল আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রয়োজনে করোনা আক্রান্ত নন এমন রোগীকেও আক্রান্ত বানানোরও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়ার। এসব বন্ধে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে জোর দাবি জানান ভুক্তভোগীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অযৌক্তিকভাবে উচ্চমাত্রায় চার্জ নিচ্ছে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। এমনটি হওয়ার একটিই কারণ, অক্সিজেনের জন্য কত ফি নেওয়া যাবে সেই বিষয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা না থাকা।
বেসরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন এমন একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন, রোগী নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ বেশ পুরনো। করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দেওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তাদের পরীক্ষা বা চিকিৎসার সুযোগ দিলে এমন বাণিজ্যের উৎসব শুরু হবে। পরবর্তী সময়ে যা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে সে কারণেই শুরুর দিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা এবং এ ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ চিকিৎসার অনুমতি দিতে দেরি করা হচ্ছিল।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনা চিকিৎসার নামে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এভাবে বড় আকারের বিল আদায়ের কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারের উচিত হবে বিষয়গুলো দ্রুত অনুসন্ধান করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। এভাবে চলতে থাকলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’
সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সেবা ও খরচ প্রসঙ্গে মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে নির্মিত ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো ও বিশেষজ্ঞ সেবা একমাত্র সরকারি হাসপাতালেই পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে খরচও কম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খুবই উন্নত মানের এবং সর্বাধুনিক আইসিইউ তৈরি করেছি। আইসিইউটা আমাদের ফ্রি থাকবেই। আমাদের সরকারি সব হাসপাতালেই আইসিইউ ফ্রি।’
১০ টাকায় আইসিইউ সেবা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে সেবা দেওয়ার। এখানে ১০ টাকায় চিকিৎসা বলতে, যেকোনো রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে ১০ টাকার একটি টিকিট কাটতে হয়। এটাই রোগীর খরচ। আইসিইউসহ যত ধরনের সেবা আমাদের রয়েছে, রোগীরা সব বিনামূল্যে পাবেন। আমরা চেষ্টা করছি যেন এই ১০ টাকাতেই রোগীরা সব ধরনের সেবা হাসপাতাল থেকে নিতে পারেন। এর বাইরে রোগীকে যেন পয়সা খরচ করতে না হয়।’
নাসির উদ্দিন বলেন, ‘একটা পর্যায়ে হয়তো পারব না। রোগীর সংখ্যা যদি অনেক বেড়ে যায়, তখন এটা খুবই কঠিন হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রোগীরা ফ্রিতে আইসিইউ সেবা নিচ্ছেন। খরচ করার কোনো প্রয়োজনই হচ্ছে না।’
করোনা রোগীদের ওষুধপত্রে কেমন খরচ হয়- জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কোনো রোগীকেই কোনো ওষুধ আমি কিনতে দিচ্ছি না। যা ওষুধপত্র লাগে সব আমরাই দিচ্ছি। যেহেতু আমরা সবকিছুই বিনামূল্যে দিচ্ছি, রোগীর তো কোনো খরচ হওয়ার কথা না। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি রোগীর চাপ অনেক বেড়ে যায়, তখন হয়তো সব রোগীকে সব ওষুধ দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সক্ষমতা থাকবে, আমরা এভাবেই চালিয়ে যাব।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) পর্যন্ত রাজধানীর ১৩টি সরকারি হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২৪২টি, এর মধ্যে শয্যা খালি রয়েছে ২২টি। তবে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাসহ আইসিইউ শয্যা রয়েছে মোট ৪৬৮টি। এছাড়াও অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটরসহ এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা সংখ্যা ১৬৪টি।
এদিকে, রাজধানীর ১৬টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৫১৪টি। এর মধ্যে শয্যা খালি রয়েছে ১৩৯টি। তবে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলাসহ আইসিইউ শয্যা রয়েছে মোট ৩৫৫টি। এছাড়াও অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটরসহ এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা রয়েছে ১০৬টি। সবমিলিয়ে রাজধানীতে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২৯টি হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যা ৭৫৬টি, এর মধ্যে শয্যা খালি রয়েছে ১৬১টি। তবে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলাসহ আইসিইউ শয্যা রয়েছে মোট ৮২৩টি। এছাড়াও অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটরসহ এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা রয়েছে ২৭০টি।
এর আগে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, দেশে করোনা চিকিৎসায় এক বছরে ৭০০ বেশি আইসিইউ বেড়েছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য মোট আইসিইউ বেড আছে এক হাজার পাঁচটি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। আগেরবার থেকে এবার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। গত পাঁচ দিনের মধ্যে চার দিনই মৃতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। সংক্রমণের সংখ্যা থাকছে চার হাজারের উপরে। গত বছর এই সময়ে আইসিইউ শয্যা ছিল ৩০০টি। এক বছরে সেটি বেড়েছে ৭০০ বেশি। তবে কোনো হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা আছে তা আগে থেকে জেনে নিয়ে রোগী ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন ডা. রোবেদ আমিন।
টিআই/এফআর