ঢামেকে ‘টাকা আছে সিট আছে, টাকা নাই বেরিয়ে যান’
মো. তাহের আলী নারায়ণগঞ্জ থেকে তার স্ত্রী পুতুলকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) এসেছেন। পুতুলের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। করোনা ইউনিটের জরুরি বিভাগে গিয়ে তাহের আলী জানতে পারলেন, সিট খালি নেই।
তাহের করোনা ইউনিট থেকে বের হলেন। এগিয়ে এলেন কয়েকজন লোক, যারা আশপাশেই ঘুরছিলেন। এদের মধ্যে একজন বললেন, ১৫০০ টাকা হলে সিট পাবেন। তাহের আলী বললেন, আমি গরিব মানুষ, এত টাকা কোথায় পাব? ২০০ টাকা কম নেন। উত্তরে সিট ম্যানেজ করে দিতে চাওয়া ব্যক্তি বললেন, টাকা আছে সিট আছে, টাকা নাই- বেরিয়ে যান।
ভুক্তভোগী তাহের আলী ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বলেন, করোনার এই সময় সিট যেন এক সোনার হরিণ। টাকার দিকে চেয়ে কী হবে? আগে তো জীবন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হুইল চেয়ারে উঠলেই ২-৩শ টাকা গুনতে হয়। না দিলে রোগী অ্যাম্বুলেন্সেই পড়ে থাকে, হুইল চেয়ারে তোলে না।
বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে সিট ও হুইল চেয়ার বাণিজ্য বিষয়ে অভিযোগ জানতে পারেন ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক।
১৪শ টাকা দিয়ে সিট নেওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের তাহের আলী ঢাকা পোস্টকে বললেন, গত শুক্রবার (৯ এপ্রিল) আমার স্ত্রীর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। জরুরিভাবে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। এরপরই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছি।
তিনি জানান, মৌখিক চুক্তির শুরুতে ৯শ টাকা ও ওয়ার্ডে যাওয়ার পর দালালদের ৫০০ টাকা দেন তিনি। তাহের আলী বলেন, হুইল চেয়ারে করে আমার স্ত্রীকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে ওয়ার্ডে নেওয়ার জন্য ৩০০ টাকা চায়। টাকা না দিলে খারাপ ব্যবহার করে। পরে ২০০ টাকা দেই। আমার স্ত্রী এখন ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছে।
‘কারা আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের নাম কীভাবে বলব? তারা তো এখানেই ডিউটি করে।
রাজধানীর মিরপুর থেকে বুধবার (১৪ এপ্রিল) ঢামেকে আসেন করোনা আক্রান্ত ফারুকুল ইসলাম। তাকে নিয়ে ভোগান্তির কথা জানান ভাতিজা আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, এখানের ভোগান্তির রোজকার চিত্র একই। আসার পর শুনি সিট নেই, পরে ম্যানেজ হলো। হুইল চেয়ারে উঠে দিতে হলো ৩০০ টাকা চাঁদা। ৯০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তির পর বুঝলাম একটি ময়লার ভাগাড়ে এসে পড়েছেন করোনা আক্রান্ত চাচা।
আবু সুফিয়ানের অভিযোগ, হাসপাতালের স্টাফদের ব্যবহার দেখলে অবাক হতে হয়। সব সময় তাদের মেজাজ চড়ে থাকে। পানি গরম করে রোগীকে খাওয়াতে গেলেও যা তা ব্যবহার করে। সিটের পাশে ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে, পরিষ্কার করার বালাই নেই। এখানে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত একটা কঠিন সিন্ডিকেট।
তিনি আরও বলেন, এখানে সব কিছু চলে সিন্ডিকেটে। চাইলেও দালালের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন না। টাকা দিলে সব মিলবে, টাকা না থাকলে সেবা তো দূরের কথা হাসপাতালেই ঢুকতে পারবেন না। আর তারা যদি বোঝে আপনি হাসপাতালের কোনো সিস্টেম বোঝেন না, তাহলে আপনার বিপদের শেষ নেই। পদে পদে টাকা কত যাবে তার কোনো ঠিক নেই। এটা এখানের ওপেন সিক্রেট, সবাই জানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নার্স-স্টাফদের ভাব দেখে মনে হয় তারা প্রেসিডেন্টের চেয়েও উপরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিউটিরত এক আনসার ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা ইউনিটে ভর্তি, হুইল চেয়ার ও ট্রলি বাণিজ্য এখানের প্রতিদিনের চিত্র। ভর্তি হতে একটা চক্র হাজার হাজার টাকা নিচ্ছে। যাদের মামা খালু নেই তাদের জন্য দালাল টপকে এখানে ভর্তি হওয়া সহজ কাজ না।
তিনি জানান, এখানে হুইল চেয়ার ও ট্রলি আরেকটা জমজমাট ধান্দা। রোগী উঠালেই ২০০-৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। দিতে না চাইলে গ্যাঞ্জাম শুরু করে দেয়। সবাই এসব জানে। এসব ধান্দা আর চান্দাবাজি চলে প্রকাশ্যেই। তবে সাংবাদিক দেখলে এই চক্রের লোকেরা গা ঢাকা দেন। সাংবাদিক চলে গেলে ফিরে আসে।
ঢামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিট-২-এর ওয়ার্ড মাস্টার মো. রিয়াজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার করোনা পজিটিভ। এখন হাসপাতালে ভর্তি আছি।
রোগীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব অনিয়মের বিষয়ে জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আগামী ২ দিনের মধ্যে রোস্টার পরিবর্তন করে দেবো। খোঁজ রাইখেন কোথায় পাঠাই এদের।
তিনি আরও বলেন, গোপনে আমাকে নামগুলো দিয়েন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চেয়ার-ট্রলি ধান্দাবাজির বিষয়টি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক স্বীকার করেছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, এখানে একটি চক্র আছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা যখন রাউন্ডে (সরেজমিনে দেখতে) যাই তখন এরা খবর পেয়ে চলে যায়। আবার ঘুরে ফিরে আসে।
তিনি বলেন, এই চক্রটির নামে কেউ অভিযোগ না করায়, আমরা অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারি না। কয়েক দিন আগে এক জনকে ধরেছিলাম। তখন মহিলা বলেন, এটা আমার রোগী। রোগীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কোনো উত্তর দেননি।
হাসপাতাল পরিচালক আরও বলেন, এদের হাসপাতাল ছাড়া করতে সরকারের কাছে ৮৮ জন লোক নিয়োগের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রস্তাবটি অর্থমন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে।
ঢামেকে করোনা রোগীরর জন্য বেডের চিত্র
করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের নতুন ও পুরাতন বার্ন ইউনিট ভবনে মোট ৮০০টি বেড রয়েছে। এছাড়া ২০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং ৪০টি হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) আছে।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইসিইউ এবং এইচডিইউতে কোনো সিট খালি নেই।
ঢামেকে কর্মরত এক নার্স ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে সাধারণ করোনা ইউনিটে কোনো বেডই খালি নেই। কোনো রোগী মারা গেলে অথবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেই কেবল নতুন রোগীদের বেড দেওয়া সম্ভব।
দেশের করোনা পরিস্থিতি
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি দেশে একদিনে করোনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮১ জনে। একই সময়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ১৯২ জন। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৭ হাজার ৩৬২ জন।
বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৯১৫ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২১৪ জন।
এসএএ/এইচকে