শিখন প্রতিবন্ধকতা: শিক্ষার্থীদের বৈচিত্রের এক অপরিচিত রূপ

আমাদের আশেপাশে অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বিদ্যালয়ে পড়াশোনাসহ নানা ক্ষেত্রে সহপাঠীদের থেকে পিছিয়ে পড়ে। এমনকি বিদ্যালয় থেকে ঝরেও পড়ে। অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরেব্রাল পালসি, বাক-শ্রবণ কিংবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতার মতো দৃশ্যমান না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিখন প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি অগোচরে থেকে যায়, যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা এখন সময়ের দাবি।
সুনির্দিষ্টভাবে পড়া, লেখা, গাণিতিক দক্ষতা, যুক্তির দক্ষতা, ভাষার ব্যবহার ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ঘাটতিই মূলত শিখন প্রতিবন্ধকতা (Learning Disabilities)। এর বেশ কিছু ধরণ থাকলেও সাধারণত তিন ধরনের উপসর্গ বেশি লক্ষ্য করা যায়। ডিসলেক্সিয়া (dyslexia) বা পঠন বৈকল্যের ফলে শিক্ষার্থীরা রিডিং পড়া, বানান করা, কোনো বর্ণ বা শব্দের সঠিক উচ্চারণ, কথা বলা বা ভাষার সঠিক ব্যবহার, ছড়া-কবিতা বা গল্প বলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঘাটতি প্রকাশ করে থাকে। ডিসগ্রাফিয়া (dysgraphia) বা লিখন বৈকল্যের ফলে লেখার সময় বানানসহ নানা রকম ভুল করা, বর্ণের আকার অস্বাভাবিকভাবে ছোট-বড় করে লেখা, আঁকাবাঁকা লেখা, ছবি আঁকতে না পারা, লিখতে দীর্ঘ সময় লাগা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। ডিসক্যালকুলিয়া (dyscalculia) বা গাণিতিক বৈকল্যের ফলে সংখ্যার ধারণা যেমন-উচ্চতা, আকার -আকৃতি, ওজন, পরিমাপ ইত্যাদি, গণনা, নামতা, যোগ-বিয়োগ বা গুণ - ভাগ, গাণিতিক সম্পর্কের ভাষা, টাকার ধারণা, মোবাইল নম্বর বা রোল নম্বর ইত্যাদি আয়ত্তের ক্ষেত্রে অপারগতা বা ঘাটতি প্রকাশ পায়।
শিখন প্রতিবন্ধকতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো শিশু-কিশোরদের মাঝে বিদ্যালয়ে, বাড়িতে এমনকি খেলার মাঠেও প্রকাশ পেতে পারে।
ব্যক্তিভেদে উপসর্গের ভিন্নতা থাকলেও অতি সাধারণ কিছু লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আলোচনার দাবিদার। যেমন- বিকাশমূলক নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিলম্ব (যেমন, দেরিতে কথা বলতে বা বুঝতে শেখা), অক্ষর ও বর্ণ বুঝতে না পারা, সংখ্যা গণনা, নামতা, যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ ইত্যাদি গাণিতিক দক্ষতায় লক্ষণীয় ঘাটতি, রং, আকার - আকৃতি, স্থান, সময় ইত্যাদি ধারণা বুঝতে না পারা, সঠিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ করতে না পারা, ছড়া, গল্প, কৌতুক ইত্যাদির প্রতি অনাগ্রহ, স্কুলে যেতে না চাওয়া বা অস্থিরতা প্রকাশ করা, স্কুলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলা, স্কুলের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে অনাগ্রহ বা অপারগতা প্রকাশ করা, পড়ার সময় হলে বা পড়ার কথা শুনলে ভয় বা অনাগ্রহ দেখানো, পড়ার সময় অস্বাভাবিকভাবে অমনোযোগী বা অন্যমনস্ক থাকা, কোনো বিষয় পড়তে বা লিখতে অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ সময় নেয়া, হোমওয়ার্ক বা বাড়ির পড়া শেষ করতে বার বার সাহায্য চাওয়া, স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করা বা অস্বাভাবিকভাবে কম নম্বর পাওয়া ইত্যাদি। পড়াশোনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণে তাদের মাঝে নেতিবাচক মানসিকতা ও আচরণ দেখা যেতে পারে। এই উপসর্গসমূহ থেকে কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ধারণা করা যায়।
শিখন প্রতিবন্ধকতা বা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে তেমন জানা না গেলেও মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতার স্বাভাবিক বিকাশে জটিলতার প্রভাব অনস্বীকার্য। কতিপয় ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবকসমূহ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে। তন্মধ্যে বংশগত বা পরিবারের কারো বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতি, গর্ভকালীন জটিলতা যেমন-অপুষ্টি, নির্দিষ্ট অসুস্থতা, ধূমপান, নেশাজাত দ্রব্য বা নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবন, তেজস্ক্রিয় বস্তুর সংস্পর্শ (যেমন – এক্সরে) ইত্যাদি, জন্ম ও শৈশবকালীন জটিলতা যেমন-৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম, মস্তিষ্কে আঘাত, অপুষ্টি ইত্যাদি, নির্দিষ্ট কোনো অসুস্থতা, পরিবেশ দূষণ, ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শ, শৈশবকালে পরিবেশের সাথে মেশার পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া বা শিক্ষার পরিবেশ না পাওয়া, এবং শৈশবকালে অতিরিক্ত মোবাইল বা টিভির সংস্পর্শে থাকা ইত্যাদি বহুল আলোচিত।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো পিতামাতা কিংবা শিক্ষকের বিবেচনায় থাকা প্রয়োজন, যাতে একজন শিক্ষার্থীর সুনির্দিষ্ট ঘাটতি চিহ্নিত করে তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে এমন শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে নানা ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। যার ফলে পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। তাদের অবস্থা সম্পর্কে না জানার কারণে তারা পরিবার, সমাজ, সহপাঠী এমনকি শিক্ষকের দ্বারাও প্রতিনিয়ত কটু কথা, গালি, অপমান, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, শাস্তি ইত্যাদির শিকার হচ্ছে । নিজের অপারগতার পাশাপাশি এমন শারীরিক ও মানসিক
হয়রানির কারণে তাদের জীবনে হতাশা, বেকারত্ব, বিচ্ছেদ, নেশা এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, জ্বীনে ধরা, অলস, বোকা, পাগল বা মানসিক বিকারগ্রস্থ নয়;তাদের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক বা সাধারণের থেকেও বেশি হতে পারে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে স্কুল ফাঁকি দিতে চায় না, হোমওয়ার্ক করতে চায় না- এটি সঠিক নয়। বরং তারা পর্যাপ্ত উৎসাহ ও সুযোগ পায় না বলে পড়াশোনা এড়িয়ে যেতে চায়। যথাযথ যত্ন, পরিচর্যা ও মানসিক সহযোগিতার ফলে তাদের এই ঘাটতি অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। উন্নত বিশ্বে এই প্রতিবন্ধকতাকে রুখতে সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় নানা পদ্ধতির চর্চা চলমান। সামাজিক বোধগম্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেও এ বিষয়ে সঠিক তথ্যজ্ঞানের প্রচার ও সঠিক চর্চার বিকল্প নেই।
এই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে ইউনিভার্সিটি অফ লিবার্যাল আর্টস বাংলাদেশ-এর সেন্টার ফর এন্টারপ্রাইজ এন্ড সোসাইটির ডাইভার্সিটি ফেলোশিপ প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত একটি উদ্যোগ হলো সমাজে ও শিক্ষাক্ষেত্রে শিখন প্রতিবন্ধকতার গ্রহণীয়তা বৃদ্ধি করতে সচেতনতা ক্যাম্পেইন। এমন উদ্যোগের বেগময়তা
প্রয়োজন। আসুন শিখন প্রতিবন্ধকতাকে জানি, অন্যকে জানাই। আসুন শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করতে শিখি।
মোঃ মুতিউল ইসলাম
ফেলো, সেন্টার ফর এন্টারপ্রাইজ এন্ড সোসাইটি
ইউনিভার্সিটি অফ লিবার্যাল আর্টস বাংলাদেশ ও গবেষণা সহযোগী, মাতৃভাষা পিডিয়া, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট