মুগদা মেডিকেলে নিত্যদিনের ‘যুদ্ধ’ লিফটে ওঠা
# লিফট আছে ৫টি, চলে ২টি
# লিফটম্যান থাকে না, ১২ বছরের পুরোনো লিফট
# নিয়মিত রোগীরাও লিফটে উঠতে পারেন না
# ৭-৮ তলার ওয়ার্ডেও হেঁটে উঠতে হয়
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মো. গফুর মিয়া। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে যাবেন তিনি। লিফটের সামনে লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছেন আরও অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা।
লিফট নিচ থেকে উপরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে সময় লেগে গেল প্রায় পাঁচ মিনিট। এরপর নিচে এসে দরজা খুলতেই হুড়োহুড়ি করে ভেতরে উঠতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। এক পর্যায়ে লিফটটি পূর্ণ হয়ে গেল। গফুর মিয়া ও তার স্বজনরা উঠতে পারল না। জ্বরে কাবু গফুর মিয়া বসে পড়ল হাসপাতালের মেঝেতে।
পাঁচ মিনিট পর আবারও লিফট নিচে আসল। এবার জায়গা হলো গফুর মিয়ার।
হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ রোগীকেই লিফটে ওঠার এমন ‘অকারণ যুদ্ধে’ জয়ী হয়ে ডাক্তারের কাছে কিংবা ওয়ার্ডে যেতে হয় বলে জানা গেছে।
সোমবার (১০ জুলাই) দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থান করে লিফটে ওঠার জন্য রোগী ও স্বজনদের কষ্ট করার নানা চিত্র দেখতে পায় ঢাকা পোস্ট।
উপস্থিত রোগীরা বলছেন, লিফটের এ ভোগান্তি এখানকার নিয়মিত চিত্র। অথচ এই হাসপাতালে বড় বড় ৫টি লিফট আছে। কর্তৃপক্ষ এটা দেখেও না দেখার ভান করে আছে।
আরও পড়ুন>>অস্বাভাবিক অনুভব করলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করুন
জানা গেছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৫০০ শয্যার হলেও এর বিপরীতে রোগী ভর্তি থাকেন এক হাজার থেকে ১২০০ জন। বিশাল সংখ্যক এই রোগীর চাপ সামলাতে সবমিলিয়ে মোট ৫টি লিফট রয়েছে। তবে রোগী ও তার স্বজনদের জন্য চালু থাকে কেবল দুটি লিফট। যে কারণে লিফটের সামনে সবসময় অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জনের লাইন লেগে থাকে। কখনো কখনো এই লাইনে ১০০ জনও অপেক্ষা করেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত গফুর মিয়ার স্বজন আমিনুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা না হয় রোগীর স্বজন, লিফটে না উঠে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। কিন্তু রোগী তো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারবে না। লিফটের সামনে এত মানুষ, কাকে রেখে কে যাবে- সবসময় একটা হুড়োহুড়ি পরিস্থিতি থাকে।
তিনি বলেন, হাসপাতালে শুধু রোগীদের জন্য আলাদা অন্তত ২টি লিফট প্রয়োজন। প্রতিদিন এখানে শত শত রোগী আসে। কিছু রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। তাকেও লিফটের সামনে অপেক্ষা করতে হয়। আবার লিফটে অধিকাংশ সময় লিফটম্যান থাকে না। যে কারণে দুর্ভোগ আরও বেশি হয়।
লিফটের সামনে অপেক্ষারত মারুফ হোসেন নামে এক স্বজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালের ৮ তলায় আমার রোগী আছে। তার ওষুধপত্র ও খাবারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচবার আমাকে নিচে নামতে হয়। প্রতিবারই লিফটের সামনে এসে লম্বা সিরিয়ালের মুখোমুখি হই। এত ওপরে সিঁড়িতে ওঠা-নামার সাহসও করতে পারি না।
হাসপাতালের এক সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, রাত ৮টার পর পুরো হাসপাতালে মাত্র একটি লিফট চালু থাকে। চিকিৎসক ও নার্সসহ রোগীদেরও এই একটি লিফটের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা যারা রাতে ডিউটি করি, তাদেরও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
তিনি বলেন, পাশেই আরও দুটি লিফট আছে। একটি ডাক্তারদের জন্য। আরেকটিতে হাসপাতালের পরিচালক ওঠা-নামা করেন। সেগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধ করে রাখা হয়। যখন তারা ওঠা-নামা করেন, কেবল তখন খুলে দেওয়া হয়। সেগুলোতে রোগীদেরও ওঠার সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটিতে কর্মরত এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালের লিফটের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় প্রতিদিনই লিফটে উঠতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি হয়। গত পরশু নিচতলায় পুলিশ-আনসারের সামনেই দুই রোগীর স্বজনদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে।
তিনি বলেন, এ হাসপাতালের লিফট মোট পাঁচটি। অধিকাংশ সময় তিনটি লিফট বন্ধ থাকে। যে কারণে দুটি লিফটের সামনে বড় লাইন সৃষ্টি হয়। এই দুটি লিফট দিয়েই রোগী, স্বজন, হাসপাতাল স্টাফ এবং খাবার-দাবার উপরে ওঠানো হয়। নিচতলা থেকে কোনোরকমে উপরে পৌঁছাতে পারলেও তৃতীয়তলা থেকে যদি কোনো রোগী ১০ তলায় যেতে চায়, তাহলে লিফটে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। কারণ নিচতলা থেকেই লিফট ভর্তি হয়ে যায়। এর ফলে রোগীদেরও প্রায়ই বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়।
আরও পড়ুন>>ডেঙ্গু চিকিৎসায় ‘ভরসা’ মুগদা হাসপাতাল, ঠাঁই নেই মেঝেতেও
হাসপাতালের এক সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, রাত ৮টার পর পুরো হাসপাতালে মাত্র একটি লিফট চালু থাকে। চিকিৎসক ও নার্সসহ রোগীদেরও এই একটি লিফটের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা যারা রাতে ডিউটি করি, তাদেরও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। লিফটে যেতে হলে অন্তত ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটা তো ইচ্ছাকৃত কষ্ট দেওয়া। লিফট আছে কিন্তু চালু নেই!
তিনি বলেন, অনেক গর্ভবতী স্টাফ আছে যাদের তৃতীয় তলায় গিয়ে অ্যাটেনডেন্স শিটে সই করতে হয়। সই করার পর তৃতীয়তলা থেকে নয় তলা বা ১০ তলায় যাওয়ার জন্য লিফটে ওঠার সুযোগই পাওয়া যায় না। কারণ নিচতলা থেকেই লিফট ভর্তি হয়ে যায়। এছাড়া স্টাফদের লিফটও বন্ধ থাকে। এর ফলে গর্ভবতী স্টাফদেরও বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ৯-১০ তলায় যেতে হয়। অনেক গর্ভবতী রোগীর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালের লিফট মূলত চারটি (একটি চিকিৎসকদের জন্য)। এই চারটি লিফট আমি কীভাবে ২৪ ঘণ্টা রেশনিং করব? সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সবচেয়ে পিক আওয়ার থাকে। আমরা সবসময় দুটি লিফট চালু রাখি। এর মধ্যে একটি লিফট থামে ৪, ৬, ৮, ১০ ও ১২ তলায়। অন্যটি থামে ৫, ৭, ৯ ও ১১ তলায়। এক্ষেত্রে আমার আর কিছু করার নেই। কারণ লিফটগুলো ১২ বছরের পুরোনো। প্রতিটি লিফট ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা চালানোর পর বন্ধ হয়ে যায়। চাইলেও এগুলোকে সবসময় চালু রাখতে পারব না।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৫০০ শয্যার হলেও রোগী ভর্তি থাকেন এক হাজার থেকে ১২০০ জন। বিশাল সংখ্যক এই রোগীর চাপ সামলাতে মোট ৫টি লিফট রয়েছে। তবে রোগী ও তার স্বজনদের জন্য চালু থাকে কেবল দুটি লিফট। যে কারণে লিফটের সামনে সবসময় অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জনের লাইন লেগে থাকে। কখনো কখনো এই লাইনে ১০০ জনও অপেক্ষা করেন।
লিফটে উঠতে ভোগান্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, একজন রোগীর সঙ্গে চার থেকে পাঁচজন করে স্বজন আসে। এটি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, এক হাজারের বেশি রোগী থাকে। এখন প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে যদি চার-পাঁচজন করে স্বজন হাসপাতালে আসে, তাহলে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার মানুষ হাসপাতালে আসা-যাওয়া করে। আমি কীভাবে এত মানুষকে ২৪ ঘণ্টা লিফট সার্ভিস দেব? আমি যদি সবগুলো লিফট একসঙ্গে চালিয়ে দিই তাহলে কাল থেকে আর একটিও চলবে না। রোগী এবং দর্শনার্থীদের পাশাপাশি আমাকে এসব বিষয়েও খেয়াল রাখতে হয়।
নতুন লিফট স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, ইতোমধ্যে আমরা নতুন দুটি লিফট স্থাপনের ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনি তো জানেন সরকারি জিনিস ছাড় করিয়ে আনা কতটা ঝামেলার ব্যাপার। ইতোমধ্যে লিফট স্থাপনের বিষয়ে ইলেকট্রিক্যাল এবং সিভিল সার্ভে হয়েছে। তারা বলেছে এই বিল্ডিংয়ে লিফট দেওয়া যাবে। এখন সেগুলো আর্কিটেক্টের কাছে অনুমোদনের জন্য আছে। সেখানে অনুমোদন হয়ে গেলে লিফটের বিষয়টি অনেকটা এগিয়ে যাবে।
টিআই/কেএ/জেএস