বাঁচা-মরা আল্লাহর ইচ্ছা, আঁখি প্রসঙ্গে ডা. সংযুক্তা সাহা
রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা এবং কর্তৃপক্ষের প্রতারণার বলি হয়ে নবজাতকের মৃত্যু ও মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির ঘটনায় ব্যাপক সমালোচিত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা বলেছেন ‘বাঁচা-মরা আল্লাহর ইচ্ছা।’ নবজাতকের মৃত্যু এবং প্রসূতির গুরুতর শারীরিক পরিস্থিতির পেছনে চিকিৎসক হিসেবে নিজের কোনো দায় দেখছেন না তিনি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোগীর পরিবার অনেক কিছুই বলতে পারে, কারণ তারা স্বজন হারিয়েছেন। কিন্তু বাঁচা-মরা তো আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা তো ইচ্ছা করে কাউকে মেরে ফেলি না।’
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) সকালে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটাই করে থাকি। তারপরও অনেক সময় রোগীকে বাঁচাতে পারি না, চিকিৎসক কখনোই জেনে-বুঝে রোগীকে সমস্যায় ফেলতে পারেন না।’
>> সেন্ট্রাল হসপিটালের ভুলে মৃত্যুপথযাত্রী আঁখি, হারালেন নবজাতক
তিনি বলেন, ‘আমি সে সময় সেন্ট্রাল হসপিটালে ছিলাম না। যা ঘটেছে সেটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝবে। সেন্ট্রাল হসপিটাল আমার নয়, আমিিএই প্রতিষ্ঠানকে ‘ওউন’ করি না। তাছাড়া আমি সেখানে পার্মানেন্টলি কাজ করি না। আমি সেখানকার অ্যাপয়েন্টেড কোনো ডাক্তারও নই। সেদিনের ডেলিভারিতে আমার অনুপস্থিতিতে যারা ছিল সবাই তাদের নিজস্ব ডাক্তার-নার্স। সুতরাং যদি রোগীর পরিবারের সঙ্গে কিছু হয়ে থাকে, সেটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝবে।’
ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই রোগীর ক্ষেত্রে আমি যতটুকু শুনেছি, ওরা সারাদিন কোনো একটা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ট্রায়াল লেবারে ছিল। তারপর রাত ১২টায় সেন্ট্রাল হসপিটালে আসে। তখনই তাকে তাড়াহুড়া করে ডেলিভারির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভবত দেরিতে আসার কারণেই তাকে ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছে। এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না।’
আরও পড়ুন >> ‘সন্তান মারা গেছে, স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়, আমাকেও মেরে ফেলুন’
‘সংযুক্তা সাহা হাসপাতালেই আছেন’- এমন আশ্বাসে রোগীকে ডেলিভারিতে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি না থাকা সত্ত্বেও যদি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে থাকে আমি আছি, আমার আশ্বাস দিয়ে তাকে ওটিতে নিয়ে যায়, তাহলে এটি অবশ্যই অপরাধ। আমি কোনো কারণে নাও থাকতে পারি। আমি তো একজন মানুষ। হঠাৎ করে আমিও অসুস্থ হতে পারি। যদি হাসপাতালে এসে জিজ্ঞেস করা হয় ‘সংযুক্তা ম্যাডাম আছে কি না’, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে ‘না, তিনি নেই’। আমি মনে করি, এটাই ফেয়ার।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের হসপিটালে কর্তব্যরত যেসব চিকিৎসক-নার্স কাজ করেন, তাদের ডিউটি রোস্টার ফিক্সড। এখান থেকে কিন্তু কারও পালানোর কোনো সুযোগ নেই। আমি জানি না তারা রোগীকে কী বলেছিল বা আশ্বাস দিয়েছিল। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আমার কথা বলা মনে হয় সমীচীন হবে না।’
ডা. সংযুক্তা বলেন, ‘আমার বেশ কিছু রোগী আছে। যারা আমাকে বিশ্বাস করে দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসে। এখন কেউ কেউ আঁখির ঘটনায় আমাকে সম্পৃক্ত করতে চায়, যেখানে আমি ছিলামই না। আমাকে যদি রোগীর লোকেরা দোষারোপ করে, তাহলে তাদের কিছুই বলার নেই; কারণ তারা শোকের মধ্যে আছে। তারা অনেক কথাই বলতে পারেন। কিন্তু কোনো একটা কথা বলার আগে আমাদের অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। আমি যে কারও সম্বন্ধে যা ইচ্ছা বলতে পারি না।’
হাসপাতালের একটি সূত্র বলছে, ডেলিভারির সময় আপনি ভিডিও কলে ছিলেন এবং গাইডলাইন দিয়েছেন- এমন প্রসঙ্গে এই গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমার সঙ্গে কেউ ভিডিও কলে ছিল না। আমি রাত সাড়ে ১১টার দিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। এরপরও আমার দুটি ফোন খোলাই ছিল। কিন্তু সেই রাতে আমাকে রোগীর পক্ষ থেকে বা হসপিটালের পক্ষ থেকে কোনো ফোন করা হয়নি। সুতরাং আমি জানিই না রোগীটা যে এসেছে। আমি ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত যতক্ষণ হসপিটালে ছিলাম, আমার এমন কোনো রোগী হসপিটালে ভর্তি হয়নি।’
ডা. সংযুক্তা বলেন, ‘বরাবরের মতো যখন আমি বাইরে যাই, তখন দুজন প্রফেসর ডেজিগনেটেড নেটে থাকেন। তারা আমার ইমার্জেন্সি রোগীদের হ্যান্ডেল করেন। আমি সাধারণত শুক্রবার রাত ১০টার মধ্যে সমস্ত ইমারজেন্সি শেষ করি। এবার যখন রোগী আসল, তারা আসতে আসতে রাত ১২টার অধিক বেজে গিয়েছিল। তাছাড়া একটি বিশেষ কাজে আমি সেই রাতে দেশের বাইরে গিয়েছিলাম, যে কারণে আমার থাকার সুযোগ হয়নি।’
প্রসঙ্গত, সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় আঁখি নামে এক প্রসূতি মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েছেন এবং তাদের নবজাতক সন্তান মারা গেছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রসূতির স্বামী ইয়াকুব আলী।
জানা গেছে, গত তিন মাস ধরে সেন্ট্রাল হসপিটালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল বলে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই সন্তান প্রসব সম্ভব বলে তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহা।
প্রসব ব্যথা ওঠায় গত শুক্রবার (৯ জুন) রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করা হয় আঁখিকে। তখন ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন।
এ বিষয়ে আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্ত্রীকে যখন ওটিতে ঢুকানো হয় এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা শুরু করা হয়, তখনও আমি সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না জানতে চাই। কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে জানতে পেরেছি ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না এবং তারা রোগীর কোনোরকম চেক-আপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন।
টিআই/ওএফ