ইফতারে ভাজাপোড়ায় ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি
রোজার সময় ইফতারে বাংলাদেশে বেশি খাওয়া হয় ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, আলুর চপ, বুন্দিয়া, জিলাপির মতো মুখরোচক খাবার। অধিকাংশ মানুষ বাইরের দোকান থেকে এগুলো কিনে আনেন। এসব খাবারের বেশির ভাগই অতিরিক্ত তেলে ভাজা থাকে, যা বেশ অস্বাস্থ্যকর।
চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত এসব খাবার খেলে ফ্যাটি লিভার থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। তাই সংযমের এ মাসে খাবারের ব্যাপারেও সংযম দেখাতে হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম হলো লিভার। অঙ্গটি খাদ্যের পাচন প্রক্রিয়ায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। লিভার ভালো না থাকলে ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, হৃদরোগ, দীর্ঘ সময় ক্লান্তি অনুভব করা, হজমে সমস্যা, অ্যালার্জিসহ নানা জটিল রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। মূলত খাদ্যাভ্যাস থেকে লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। তাই লিভার ভালো রাখতে কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। আনতে হবে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন।
আরও পড়ুন >> রোজায় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন ডায়াবেটিক রোগী
ফ্যাটি লিভার থেকে হতে পারে লিভার ক্যান্সার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন বাংলাদেশে লিভারের যে রোগটির কথা সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, সেটি হলো ফ্যাটি লিভার। ফ্যাটি লিভারকে আমরা হয়তো সবসময় গুরুত্বের সঙ্গে নিই না, কিন্তু যাদের রোগটি থাকে তাদের অনেকেরই লিভারে প্রদাহ থাকে। যাদের লিভারে প্রদাহ থাকে, তাদের লিভার সিরোসিস ও লিভার ড্যামেজ হয়ে যাওয়াসহ লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
‘রমজান মাসে আমরা যে পরিমাণ ভাজাপোড়াসহ তৈলাক্ত খাবার খাই, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এমন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লে ভয়াবহ বিপদ হতে পারে। রোজা আসলেই প্রায় প্রতিদিন বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের দাওয়াত থাকে। এসব দাওয়াতে আমরা প্রচলিত খাবারের বাইরে অনেক কিছু খাই। এতে স্বাভাবিকভাবে ওজন বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যারা ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত, তাদের লিভার খুব দ্রুত খারাপের দিকে চলে যেতে পারে।’
ডা. মামুন বলেন, যারা লিভার সিরোসিসের রোগী, যাদের লিভারে জটিল সমস্যা আছে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ইনফেকশন হলে তারা বিপদে পড়বে। অন্যরা এ ধরনের ইনফেকশন মোকাবিলা করতে পারলেও লিভারে আক্রান্তরা পারেন না। তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর শরবতে জন্ডিসের ঝুঁকি
ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, এবার গরমকালে রোজা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষ প্রচুর পরিমাণে শরবত পান করবেন। শরবতগুলো কোন পানি দিয়ে বানানো হয়েছে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, দূষিত পানি পানের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস আমাদের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে বাংলাদেশের শিশুদের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং বড়দের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস হচ্ছে জন্ডিসের ‘কমন’ কারণ।
তিনি বলেন, জন্ডিস সাধারণত আমাদের দেহে অন্য কোনো ঝামেলা তৈরি করে না। তবে, যাদের ইতোমধ্যে হার্ট ও কিডনির রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা আছে, তাদের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ‘ই’ জনিত জন্ডিস মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সবমিলিয়ে রমজান মাসে ইফতার, সেহরি ও বাইরে দাওয়াত খাওয়ার ব্যাপারে আমরা অবশ্যই সচেতন হব। যারা লিভারের রোগী তাদের বেশি সচেতন হতে হবে।
লিভারকে সুস্থ রাখতে রোজায় কী কী খাবেন
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, রোজার ইফতারে আমরা যে পানি পান করব সেটি অবশ্যই ফোটানো বা মিনারেল ওয়াটার হতে হবে। কারণ, অস্বাস্থ্যকর পানি পানের মাধ্যমে শরীরে হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
তিনি বলেন, শর্করা জাতীয় খাবার খুব বেশি খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত শর্করা লিভারে বাড়তি চর্বি জমায়। ভাজাপোড়া না খেয়ে শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া উচিত। ছোলা-বুট এগুলো অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। যে খাবারই খাই না কেন সেটি স্বাস্থ্যকর কি না, তা দেখতে হবে।
তেল-মসলায় ভেজাল, পেটে সমস্যা দেখা দেওয়া ‘স্বাভাবিক’
শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে কোনো খাবার পেট, লিভার ও হজম প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। খাবারে তারতম্য হলে শরীর খারাপ করবে। গলা ও বুক জ্বালাপোড়া, পেটে মোচড় দেওয়া, লিভার ফাংশনে গোলমাল হওয়া— এগুলো সব খাবারের সমস্যার কারণে হয়।
তিনি বলেন, রোজার মাসে ইফতারে ভাজাপোড়া ও আনইউজ্যুয়াল (অস্বাভাবিক) খাবার খাওয়া হয়। খাবারগুলো সাধারণত বাইরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয়। যে তেল দিয়ে তৈরি করা হয়, সেটির মধ্যে ভেজাল থাকে। এমনকি মসলাতেও ভেজাল থাকে। ভেজালযুক্ত খাবার যখন পেটে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
ভেজাল খাবারে লিভার আরও বেশি দুর্বল হতে পারে
ডা. গোলাম কিবরিয়া বলেন, সাধারণত খাবার হজম হওয়ার পর সেগুলোর পুষ্টিগুণ লিভারে যায়। তাই বিষাক্ত, ভেজাল ও বিভিন্ন প্রিজারভেটিভ মিশ্রিত খাবার খেলে তা লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যাদের লিভারে দুর্বলতা আছে, এসব খাবার তাদের লিভারকে আরও বেশি দুর্বল করে দিতে পারে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন ফ্যাটি লিভার এক ভয়ের কারণ। দিন দিন এতে আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এ রোগে আক্রান্তরা সারাদিন রোজা রেখে অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ করলে তাদের ক্যালরি আরও বেড়ে যায়। এমনটি চলতে থাকলে তাদের লিভার আরও খারাপ হতে পারে।
লিভার ভালো রাখতে যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
১. কেক, পেস্ট্রি ও কুকিজের মতো খাবার লিভারের জন্য ভালো নয়। সকালের খাবারে অনেকে পাউরুটিতে জেলি মাখিয়ে খান। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের খাবারে ট্রান্সফ্যাট থাকে। এ ফ্যাট নিয়মিত লিভারে গেলে ক্ষতি হতে পারে।
২. শুধু পাউরুটিতে নয়, বাইরের ভাজাপোড়া, তেল-মসলাদার, চপ-কাটলেটের মতো খাবারেও ভরপুর ফ্যাট থাকে। নিয়মিত এ ধরনের খাবার গ্রহণে লিভারের নানা সমস্যা তৈরি হয়। পরবর্তীতে এর ফলে লিভারের বড় ধরনের রোগ হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
৩. নিয়মিত মদ্যপান লিভারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। লিভার রক্তে অবস্থিত অ্যালকোহল দূর করে রক্তকে পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। কাজেই অতিরিক্ত মদ্যপান করলে লিভারের ওপর চাপ পড়ে। এতে লিভারের কোষগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। লিভার সুস্থ রাখতে তাই মদপান এড়িয়ে চলা জরুরি।
৪. মাত্রাতিরিক্ত হারে চিনি খাওয়ার অভ্যাসও লিভারের ক্ষতি করতে পারে। সরাসরি চিনি খাওয়া তো ক্ষতিকর বটেই। এছাড়া চিনি আছে এমন খাবার যেমন- মিষ্টি, ক্যান্ডি ও চকলেট নিয়মিত খেলে লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫. ময়দাও লিভারের জন্য ভালো নয়। ময়দার তৈরি কোনো খাবার বেশি খাওয়া ঠিক নয়। ময়দা দিয়ে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাবার লিভারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। তাই ময়দার তৈরি খাবার বেশি বা প্রতিদিন না খাওয়া ভালো।
টিআই/কেএ